৫১. প্যাসেফিকের ভয়ংকর দ্বীপে

চ্যাপ্টার

বিশ্বমিলনায়তন (Hall of World Assembly)।
বিশ্বনির্বাহীদের কাউন্সিল বৈঠক।
ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের এটাই সর্বোচ্চ পরামর্শ সভা। ব্ল্যাক সানের ৫ জন শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা এই কাউন্সিলের সদস্য। ব্ল্যাক সানের সুপ্রিম কমান্ডার ও প্রেসিডেন্ট লর্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড আলেক্সি গ্যারিন এই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
অর্ধ বৃত্তাকার টেবিল ঘিরে বসেছে পাঁচজন শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা।
টেবিলের বিপরীতে বৃত্তাকার প্রান্তের সামনে সূর্যাকার টেবিলের পেছনে কোন চেয়ার নেই।
ঠিক রাত ১২ টা বেজে ১ মিনিট ঘরের ছাদ ফুঁড়ে একটা টিউব লিফট নেমে এল। লিফটটি কালো ছিল। লিফটটি নেমে এল সূর্যাকার টেবিলটির পেছন পাশ ঘেঁষে।
লিফটটি নেমে মুহূর্তকাল স্থির হয়েই আবার উঠে গেল। লিফট উঠে যেতেই দেখা গেল সিংহাসনাকৃতির একটা চেয়ারে দীর্ঘাকৃতির একজন শিরদাঁড়া সোজা করে অ্যাটেনশন অবস্থায় বসে। দেহে তাঁর সামরিক পোশাক। মাথায় কালো সামরিক ক্যাপ। ক্যাপের সামনে ব্ল্যাক সানের একটা মনোগ্রাম। তাঁর দুই কাঁধ ও বুকে সেই একই মনোগ্রামের প্লেট।
কালো মূর্তিসহ নেমে আসা চেয়ারটি মেঝের উপর স্থির হতেই সামনে অর্ধ বৃত্তাকার টেবিলের পাঁচজন উঠে দাড়িয়ে বাউ করল।
এই কালো মূর্তিই ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রধান আলেক্সি গ্যারিন। আলেক্সি গ্যারিন মুখোশ পড়েই সবার সামনে আসে। গৌরীর মত কিছু পার্সোনাল স্টাফ ছাড়া কেউ তাকে চোখে দেখেনি। শীর্ষ এই পাঁচজন কর্মকর্তাও তাঁর পার্সোনাল স্টাফের অন্তর্ভুক্ত।
আলেক্সি গ্যারিন এসে বসার পর পরই তাঁর পেছনে এক সারিতে তিনটি চেয়ার চলে এল। আলেক্সি গ্যারিনের ঠিক পেছনে মাঝের চেয়ারে গৌরী। তাঁর ডান পাশের চেয়ারে চীফ অব অপারেশন ‘জিজর’। সে সম্পর্কে আলেক্সি গ্যারিনের ছোট ভাই। আর গৌরীর বাম পাশে রয়েছে ব্ল্যাক সানের গোয়েন্দাপ্রধান এবং আলেক্সি গ্যারিনের আরেক ছোট ভাই ডারথ ভাদের।
গৌরী তাঁর চেয়ারে বসার আগেই একটা ফাইল নিয়ে রেখে দিল আলেক্সি গ্যারিনের সামনে টেবিলের উপর।
ফাইলের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল আলেক্সি গ্যারিন।
মুখ তুলল ফাইল থেকে। সোজা হয়ে বসল।
একবার সবার উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, শুভ সময় সকলকে। লং লীভ আমাদের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট। অমর হোক আমাদের স্লোগান ‘পাওয়ার ফর পাওয়ার’ অর্থাৎ শক্তির জন্য শক্তি।
বলে একটু থামল আলেক্সি গ্যারিন। শুরু করল আবার, ব্ল্যাক সানের শীর্ষ নির্বাহীবৃন্দ, আজ এক বিশেষ বৈঠকে আমি তোমাদের ডেকেছি। উদ্দেশ্য, আমাদের এ পর্যন্ত কাজের একটা পর্যলোচনা করা এবং উদ্ভূত একটা পরিস্থিতি সম্পর্কে তোমাদের অবহিত করা। প্রথমে আমাদের কাজ নিয়ে আলোচনায় আসি। আমাদের ‘শক্তির জন্য শক্তি’ প্রজেক্টের চীফ এক্সিকিউটিভ ‘পালপেটাইন’ তোমার বিভাগের কাজের বিবরন দাও।
‘শক্তির জন্য শক্তি’ প্রজেক্টের নির্বাহী পালপেটাইন নড়েচড়ে বসল। তাঁর সামনে স্পিকার বক্সের সিগন্যাল লাইট জলে উঠেছে। স্পিকার অন হয়ে গেল। বলতে শুরু পালপেটাইন, মাই লর্ড! ‘শক্তির জন্য শক্তি’ আপনার উদ্ভাবিত সবচেয়ে প্রিয় প্রোজেক্ট। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা এই মহান প্রজেক্টের সাথে সামিল হতে পেরেছি। মাই লর্ডের এই মহান প্রজেক্টের লক্ষ্য হলো, শক্তি দিয়ে শক্তি অর্জন, সেই শক্তি দিয়ে গোটা বিশ্ব-চরাচরকে বশ করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রয়োজন গোটা দুনিয়াকে মেধাশুন্য করার মাধ্যমে শক্তি শূন্য করা এবং প্রয়োজন আমাদের ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের শক্তির রাজত্ব চিরস্থায়ী করার জন্যে দুনিয়া থেকে সকল নীতি- নৈতিকতার উচ্ছেদ ঘটানো। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে আমরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মেধাগুলো সরিয়ে আনছি দেশ ও জাতি সমুহের কাছ থেকে, বিশেষ করে মুসলিম দেশের মুসলিম মেধাকে সরিয়ে আনাকে প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। আজ দুনিয়াতে মুসলমানদের ইসলামই দুনিয়াকে ধর্মের শিক্ষামুক্ত ও নীতি- নৈতিকতামুক্ত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরআন অবিকৃত থাকায় মুসলমানদের বিশ্বাস খুবই জীবন্ত এবং মানুষের মধ্যে এর আবেদন খুবই কার্যকরি। এটাই আমাদের জন্যে বিপদ। এজন্যই মুসলিম জাতিকে মেধাশুন্য ও শক্তিশুন্য করার প্রতি প্রথমেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ারে’ সরিয়ে এনেছি, তাঁদের ৯০ ভাগই মুসলিম। এর মাধ্যমে একদিকে মুসলিম জাতিকে ক্রমবর্ধমানভাবে দুর্বল করা যাবে। অন্য দিকে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট ও তাঁর ক্যাপিটাল অব পাওয়ার শক্তিশালী হবে। এটা আমাদের সফল প্রোগ্রাম। কয়েকদিন আগে আমরা সৌদি আরবের স্পেস ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ও আলোক বিজ্ঞানের এ যুগের সবচেয়ে সফল বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মক্কীকে সরিয়ে আনতে পেরেছি। এটা আমাদের বর্ণনাতীত বড় একটা সাফল্য। স্পেসশীপ ও সমুদ্রযানে এ্যান্টিম্যাটার ফুয়েল ব্যবহারের টেকনলজি উদ্ভাবনে তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন। এ ব্যাপারে ক্লিনিক্যাল টেস্ট তিনি করেছেন এবং তা সফল হয়েছে। তিনি এ্যান্টিম্যাটার ফুয়েল ব্যবহারের উপযোগী স্পেস মেরিনের ডিজাইন তৈরির কাজও শেষ করেছেন। এখন এই বিজ্ঞানী আমাদের হাতে। তাকে কব্জায় আনার মাধ্যমে একদিকে আমরা মুসলিম জাতির শক্তিকেন্দ্র সৌদি আরবকে এক মহাশক্তির মালিক হওয়া থেকে বঞ্চিত করেছি, অন্যদিকে এই শক্তির মালিক আমরা হতে যাচ্ছি। আমা….।
পালপেটাইনের কথার মাঝখানেই একমাত্র আলেক্সি গ্যারিন ছাড়া উপস্থিত সকলেই হাততালি দিয়ে উঠল।
থেমে গিয়েছিল পালপেটাইন। আবার শুরু করে বলল, আমাদের মটো ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ প্রোজেক্ট নিয়ে সাফল্যের সাথে এগোচ্ছি। থামল পালপেটাইন।
পিনপতন নিরবতা।
কালো ইউনিফরমে আবৃত কালো মুখোশে ঢাকা আলেক্সি গ্যারিনের মুখ নড়ে উঠল। বলল, টুডে সাইন্স অব টুমরো বাই রোবটস (রোবটস গড়ার আগামীর বিজ্ঞান আজ) আমাদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আমাদের প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করবে। এই প্রকল্পটি আমি নিজে তত্তাবধায়ন করি। এই প্রকল্পের দৈনন্দিন দেখা-শুনা আমার পক্ষ থেকে গৌরী করে থাকে। আমি তাকে বলছি, এই প্রকল্পের কাজ কিভাবে এগোচ্ছে ও কতটা এগিয়েছে তাঁর উপর একটা রিপোর্ট পেশ করতে।
কোথা থেকে যেন গৌরীর মনে অপরিচিত একটা বিষণ্ণতা নেমে এল! চমকে উঠল গৌরী। সব সময় তো সে তাঁর লর্ডের কাছ থেকে এই দায়িত্ব পেয়ে গৌরব বোধ করেছে এবং লাভ করেছে সীমাহীন আনন্দ। কিন্তু আজ এই বিষণ্ণতা কেন? সেই আনন্দের কথাগুলো বলতে আজ কষ্ট হবে বলে মনে হচ্ছে কেন?
সব ভাবনা ঝেরে ফেলে উঠে দাঁড়ালো গৌরী। আলেক্সি গ্যারিনকে ইয়েস মাই লর্ড, বলে একটা লম্বা বাউ করে একটা নোটশিট ফাইল থেকে বের করে স্পিকারের সামনে বসল। বলতে শুরু করল, মাই লর্ড ও মাই কলিগস। ‘রোবটস গড়বে আগামীর বিজ্ঞান’-প্রকল্পটি মাই লর্ডের সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারী একটা পদক্ষেপ। বিজ্ঞানী গড়ে তাঁর কাছ থেকে থেকে বাঞ্ছিত কাজ পাওয়া অসম্ভব। আমাদের প্রকল্পে বিভিন্ন বিষয়ে গড়া প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের তাঁদের স্থান থেকে সরিয়ে এনে তাঁদের স্ব স্ব বিষয়ে কাজ নেয়া হচ্ছে। এই কাজে তাঁদের রোবটে পরিনত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাঁদের প্রতিভার শেষ বিন্দু বের করে নিয়ে আগামীর বিজ্ঞানী গড়ে তোলা হচ্ছে। কাজটা কঠিন হলেও মাই লর্ডের পরিচালনায় বৈজ্ঞানিক প্রদ্ধতিতে কঠিনকে সহজ করে ফেলা হয়েছে। প্রায় পৌনে একশ’ বিজ্ঞানীর অধিকাংশই আজ আজ্ঞাবহ নিরেট রোবট। যারা রোবট হয়নি তারাও হবে। যারা হবেনা তাঁদের জন্যেও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা।
মূল উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে আমরা বহু দূর এগিয়েছি। সার্বিক কমুনিকেশনের ক্ষেত্রে এ্যান্টিম্যাটার যুগে প্রবেশ ও সামরিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে লেজার-উত্তর যুগে প্রবেশ করে অদ্বিতীয় প্রতিরক্ষা ও আক্রমনের শক্তি আমরা অর্জন করতে যাচ্ছি। আমাদের বিজ্ঞানীকে দিয়ে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি আমরা আবিষ্কার করেছি। পরিবহন ক্ষেত্রে সে জ্বালানীর সফল ল্যাবরেটরি টেস্টও আমরা করেছিলাম। আমরা এখন এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানীর মালিক। আমাদের হাতের মুঠোয় এখন এ্যান্টিম্যাটার বিজ্ঞান। সৌদি আরব থেকে সরিয়ে আনা বিজ্ঞানী খালেদ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-মক্কীর সহযোগিতা যদি আমরা আদায় করতে পারি, তাহলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি চালিত স্পেসশীপ, ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান ও সমুদ্রযান আমরা ব্যবহার করতে পারবো। তখন আমরা কয়েক মিনিটে চাঁদে যাতায়াত করতে পারবো। একদিনের মধ্যে আমরা সৌরজগতের শেষ সীমায় গিয়ে ফিরে আসতে পারবো। তখন দুনিয়ার সব পরিবহণ ব্যবস্থা অচল হয়ে যাবে। অন্যদিকে এ্যান্টিম্যাটার জ্বালানি তৈরির পাশাপাশি এ্যান্টিম্যাটার পরমাণুর আরও উন্নত রিপ্রসেসিং-এর মাধ্যমে এ্যান্টিম্যাটার বোমা তৈরির ক্ষেত্রেও আমরা বহু দূর এগিয়ে গিয়েছি। আগামী এক মাসের মধ্যে আমরা ল্যাবরেটরি টেস্ট করতে যাচ্ছি। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে আমরা সমুদ্রতলে এর টেস্টের আয়োজন করতে পারবো। আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমরা এ্যান্টিম্যাটার পরমানু বোমার মালিক হবো। ‘শক্তির জন্যে শক্তি’ অর্জনের লক্ষ্য ষোল কলায় পূর্ণ হবে। দুনিয়ার সব অস্ত্র অচল হয়ে যাবে। বিশ্বে হবো আমরাই একমাত্র শক্তি। ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট হবে দুনিয়ার ভাগ্য নির্ধারক। দুনিয়ার অচল অস্ত্রের মত ঈশ্বরও অচল হয়ে পড়বে। আমাদের লর্ড হবে দুনিয়ার লর্ড, লর্ড অব দ্য ইউনিভার্স। ধন্য….।
হাততালি দিয়ে উঠল সকলে।
হাততালির মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল গৌরীর কথা।
হাততালি শেষ হলে গৌরী বলল, আমার কথা এখানেই শেষ। ধন্যবাদ মাই লর্ড, ধন্যবাদ সকলকে।
আবার পিনপতন নিরবতা।
নিরবতা ভাঙল আলেক্সি গ্যারিন। বলল, আজকে ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সব বিষয়ে আলোচনা করছি না। আজ শেষ আলোচনার বিষয় হল, একজন বিদেশী তাহিতিতে এসে ঝামেলা পাকিয়েছে। বিষয়টি ছোট, কিন্তু আলোচনার দাবী রাখে। কারন ব্যাপারটি অনেক বড়। এ পর্যন্ত সে আমাদের পাঁচজন লোককে খুন করেছে।
একটু থামল আলেক্সি গ্যারিন।
শীর্ষ নির্বাহীদের একজন হাত তুলল।
বল। কথা বলার অনুমতি দিল আলেক্সি গ্যারিন।
মাই লর্ড, এটা একটা ব্যক্তির ব্যাপার। আপনি চাইলেও সে ইলিমিনেট হয়ে যায়। বলল সেই শীর্ষ নির্বাহী।
সে একজন ব্যক্তি বটে, কিন্তু সে একাই সহস্রের সমান। সে অপরাজিত এক ডেভিল। নাম তাঁর আহমদ মুসা। আলেক্সি গ্যারিন বলল।
আহমদ মুসার নাম শুনে মাথা খাড়া করল পাঁচ শীর্ষ নির্বাহীর সকলেই। একজন বলল, সে বিপদ এখানে এল কি করে? কেন এসেছে?
কেন এসেছে, সেটাই চিন্তার বিষয়। তোমরা জান, আমাদের একজন রোবট একটা ম্যাসেজ বাইরে পাঠাতে চেষ্টা করেছিল, আংশিক পাঠিয়েছিল। প্রমানিত হয়েছে, যখন সে ম্যাসেজটি পাঠাচ্ছিল, তখন আহমদ মুসা এক বোটে তাহনিয়া দ্বীপের এ প্রান্তে ছিল। তাঁর মনিটরিং-এ এই মেসেজ ধরা পড়েছে আমরা নিশ্চিত। সে এ নিয়ে কি ভাবছে, কি করছে তা আমরা জানিনা। তাঁর আসাটাই সন্দেহজনক। বিনা কারনে সে এক পা ফেলেনা, এটা সবাই জানে । সে নিছক বেড়াতে তাহিতিতে এসেছে এটা ঠিক নয়। সে কথাই আমি তোমাদের বলতে চাচ্ছি। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
মাই লর্ড, আহমদ মুসা খুবই বিপদজনক ব্যক্তি। শুরুতেই তাকে ইলিমিনেট করা দরকার। ঘটনাটিকে এগোতে দেয়া ঠিক নয় মাই লর্ড। বলল শীর্ষ নির্বাহীদের অন্য একজন।
সে ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। গৌরীর নেতৃত্বে একটা দক্ষ টীম পাঠিয়েছিলাম তাকে কিডন্যাপ করার জন্যে। ইতিমধ্যে পশ্চিমের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বন্ধু সংগঠন আমাদের জানাল, তাঁরা আহমদ মুসার লাশ চায়। তাঁরা অনুরোধ করে আহমদ মুসাকে হত্যা করার কোন সুযোগ ছেড়ে না দেয়ার। লাশের মুল্য হিসাবে তাঁরা দিবে ১ বিলিয়ন ডলার। তখন আহমদ মুসাকে আমরা কিডন্যাপ করে ফেলেছি। আমি গৌরীকে নির্দেশ দিলাম আহমদ মুসাকে হত্যা করার। কিন্তু তাকে হত্যা করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। গৌরী ও নাশকা মারাত্নক আহত হয়, মারা যায় আমাদের পাঁচজন। সংগে সংগেই দুই গাড়িতে দু’টি টিম পাঠিয়েছিলাম তাকে ঘিরে ফেলতে। ঘিরে ফেলেও তাঁরা তাকে আটকাতে পারেনি। আমাদের অস্ত্রে আমাদের ঘায়েল করে সে নিরাপদে বেরিয়ে যায়। তাঁর সাথে সাথেই আমি আমাদের জুনিয়র এক্সিকিউটর-১ পাঠিয়েছিলাম তাকে অনুসরন ও হত্যা করার জন্যে। কিন্তু এক্সিকিউটর-১ তাকে বাগে পেয়েও, সর্বশেষে বিষাক্ত গ্যাস তাঁর উপর প্রয়োগ করেও তাকে হত্যা করা যায়নি। তাঁর সন্ধানও পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর পর থেকে। তাঁর ব্যাপারে আরও সিরিয়াসলি ভাবা প্রয়োজন বলেই কথাটা এই বৈঠকে তুলেছি। আলেক্সি গ্যারিন বলল।
মাই লর্ড, আপনি কি আশংকা করছেন? আমাদের কি করা দরকার? আমাদের প্রতি আপনার কি পরামর্শ? বলল অন্য একজন শীর্ষ নির্বাহী।
আমি ভাবছি ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের প্রজেক্টের নিরাপত্তা নিয়ে। ব্লাক সান সিন্ডিকেটের নিরাপদ স্থান খুজতে আমি গোটা দুনিয়া চষে ফিরেছি। কিন্তু সব দিক নিরাপদ স্থান আমি পাইনি।সবশেষে সভ্যতা থেকে বহু দুরে সবচেয়ে বড় সাগরের মাঝামাঝি ও প্রায় জনশূন্য এই তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলাম। দ্বীপগুলো অ্যাটল দ্বীপ হওয়ায় নতুন জনবসতির সুযোগ এখানকার দু’একটা ছাড়া কোন অ্যাটল দ্বীপেই নেই। আমার খুব ভালো লেগেছিল স্থানটা। অ্যাটল থেকে অ্যাটলে ঘুরে বেরিয়েছি মাসের পর মাস। কিন্তু ব্ল্যাক সান-এর ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ স্থাপিত হতে পারে এমন উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাইনি। তোয়ামতু অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র দ্বীপ ‘মাকাতিয়া’র পুরানো মন্দিরে বিশ্রাম কক্ষে বসেছিলাম। অ্যাটল দ্বীপগুলোতে ঘোরাফেরার পথে প্রায়ই এই বিশ্রামখানায় বসি। পাশের রেস্টুরেন্টে তাজা মাছের ভাজি ও তাজা ফল প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো আমার প্রিয়। সেদিন রেস্টুরেন্টে খেয়ে আবার এসে বসেছিলাম মন্দিরের বিশ্রামকক্ষে। আমার সামনে বসেছিল বৃদ্ধ একজন সন্ন্যাসী। আর কেউ ছিল না বিশ্রামকক্ষে।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর চোখ সব সময় বন্ধই দেখলাম।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে থাকতে এক সময় চোখ ধরে এসেছিল।
বৎস, তুমি ঘুমালে? এই কথাগুলো কানে যাওয়ায় আমার তন্দ্রা কেটে যায়।
চোখ মেলে দেখি সন্ন্যাসী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাঁর দিকে তাকাতেই বলল, তোমার বাড়ি নিশ্চয় আমাদের অ্যাটল দীপপুঞ্জে নয়?
জি হ্যাঁ। বললাম আমি।
তুমি পর্যটকও নিশ্চয় নও? সন্ন্যাসী বলল।
জি না। আমি বললাম।
গত তিন মাসে তুমি এখানে তিরিশবার এসেছ। সন্ন্যাসী বলল।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম সন্ন্যাসীর দিকে। অনেকবার এসেছি তাহানিয়া দ্বীপের এখানে। কিন্তু তিরিশবার হয়েছে কিনা গুনে দেখিনি। আমি বললাম, বাবা, তিন মাসে আমি এখানে অনেকবার এসেছি, তিরিশবার হয়েছে কিনা আমি জানিনা। নিশ্চয় আপনার গুনা ঠিক বাবা।
তুমি নিশ্চয় কাউকে খুজছ বৎস? বলল সন্ন্যাসী।
কাউকে নয়, কিছু খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন হন্যে হয়ে কি খুজছ বৎস? বলল সন্ন্যাসী।
একটা জায়গা খুজছি বাবা। এই অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জ আমার ভালো লেগেছে। এখানে একটা নিরিবিলি স্থানে আশ্রয় গড়ার জায়গা খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন জায়গা তো প্রচুর! এত খুজছ কেন? সন্ন্যাসি বলল।
একটা বড় জায়গা যা মানুষের চোখের আড়াল হবে, এমন একটা জায়গা খুজছি বাবা। বললাম আমি।
এমন জায়গা তো ডাকাতদের আড্ডার জন্য দরকার! তুমি সে রকম কিছু করতে নিশ্চয় চাওনা? সন্ন্যাসী বলল।
আমি হেসেছিলাম। তারপর গম্ভীর হয়ে সিরিয়াসলি বলেছিলাম, ডাকাতির জন্য নয়, আমি জায়গা চাই বিশাল একটা গবেষণা সংস্থা গড়ার জন্যে যা দুনিয়াকে একশ’ বছর এগিয়ে নেবে।
এ্যাটম বোমা বানাবে এবং আমাদের পানিতে তা পরীক্ষা করবে নাকি, যেমন ফ্রান্স কয়েক যুগ ধরে করেছে। যেন আমরা ওদের গিনিপিগ! সন্ন্যাসী বলল।
বাবা, আমাদের গবেষণা ঐ ধরনের নয়। আমাদের গবেষণা আরও বড় বিষয় নিয়ে। লোক চক্ষুর আড়ালে তা হবে। মানুষ ও পরিবেশকে তা ডিস্টার্ব করবে না বাবা। আমি বললাম।
কিন্তু এর জন্যে তো ইন্সিটিটিউট ধরনের বিশাল বাড়ি ও বড় জায়গা দরকার। অ্যাটলের সারফেসে তো এমন জায়গা দেখিনা বৎস। সন্ন্যাসী বলল।
সে জন্যই তো খুজেই ফিরছি বাবা! আমি বললাম।
ভাবছিল সন্ন্যাসী।
আমিও কিছু বললাম না। চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
কিছুক্ষন পর মুখ তুলল। তাকাল আমার দিকে। বলল, প্রশান্ত মহাসাগরের এই অঞ্চলে ‘মু’ নামে একটা মহাদেশ ছিল, এটা তুমি বিশ্বাস কর?
আমি শুনেছি বাবা। কিন্তু এ নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। তবে আগ্রহ আছে জানার। বললাম আমি।
আজকের তাহিতি দ্বীপ যেমন বাস্তবতা, তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জের অস্তিত্ব যেমন বাস্তবতা, তেমনি আজকের মধ্যপ্রশান্ত মহাসাগরের মহাদেশ ‘মু’ একটা বাস্তবতা। এই মহাদেশ ছিল বিশাল ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী। পেরু ও গুয়েতেমালার পুরাকীর্তি এবং মায়া সভ্যতার বিস্ময় ‘মু’ সভ্যতারই খণ্ডাংশ। ‘মু’ মহাদেশের এক শ্রেণীর মানুষের অন্তঃসার শূন্য গর্ব, ঈশ্বরকে ত্যাগ করা, ঈশ্বরপ্রদত্ত সম্পদের ধ্বংসকারী ব্যবস্থা এবং পরিশেষে ঈশ্বরের শাস্তি ভুমিকম্প ও প্লাবনের আঘাত ধ্বংস করে ‘মু’ মহাদেশকে। অ্যাটল দ্বীপগুলোর কোন কোনটি সেই মহাদেশরই ধ্বংসাবশেষ হিসাবে টিকে আছে। এরকম একটি অ্যাটলের খবর আমি জানি, যার ভিতরে অক্ষত আছে ‘মু’ মহাদেশের রাজন্যবর্গের একটি বহুতল প্রাসাদ। থামল সন্ন্যাসী।
বহুতল প্রাসাদ? আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
হ্যাঁ, বহুতল প্রাসাদ বৎস। সন্ন্যাসী বলল।
অ্যাটলের অভ্যন্তরে? আমার জিজ্ঞাসা।
হ্যাঁ, অ্যাটলের ভিতরে। সন্ন্যাসী বলল।
আপনি সে অ্যাটলকে জানেন? জিজ্ঞাসা করলাম। বিস্ময় ও আনন্দে আমার ভেতরটা তখন কাঁপছে। রুপকথার মত মনে হচ্ছে তাঁর কথাগুলো।
অবশ্যই জানি বৎস। সেই জানাটাও একটা রুপকথার মত।
বলে একটু থামল সন্ন্যাসী। একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, তখন আমার বয়স তিরিশ। সন্ন্যাস ব্রত নিয়ে আমি তখন মন্দিরে মন্দিরে ঘুরি। একদিন এই মন্দিরেই আমার মত নব্বই-ঊর্ধ্ব এক বুড়ো সন্ন্যাসীর সাথে দেখা। ঈশ্বরী ‘হিনার’ বন্দনা চলছিল সেদিন মন্দিরে। বন্দনা শেষ হতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। বন্দনা শেষ হবার পর মন্দিরের এক কক্ষে আমি সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসিকে শুইয়ে দিতে যাই। বিছানা ঠিক করে তাকে শুইয়ে দিয়ে আমি তাকে বাতাস করছিলাম। দীর্ঘ সময় ধরে শোনা বন্দনায় অনেক কথাই মাথায় কিলবিল করছিল। তাঁর মধ্যে কিছু বিষয় আমাকে খুচাচ্ছিল বেশি। আমি গুরুকে বললাম, গুরু, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
গুরু চোখ বন্ধ করে ছিলেন। চোখ খুলে বলেছিলেন, অনুমতি নিয়ে বলতে হবে কেন? বল তোমার কথা।
গুরু বন্দনার মধ্যে শুনলাম, ঈশ্বরী হিনা রাজপুত্র হেসানা হোসানা, সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর একমন একতনু প্রেমসাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে অ্যাটলের এক প্রাসাদে তাঁদের মিলন ঘটিয়েছিলেন এবং প্রাসাদটি তাঁদের উপহার দিয়েছিলেন-এটা কি সত্য ঘটনা? ঈশ্বরী হিনা কি সত্যিই এটা করেছিলেন?
বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
সন্ন্যাসী শোয়া থেকে উঠে বসেছিলেন। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলেছিলেন, তোমার কি সন্দেহ আছে এ কথায়?
সন্দেহ নেই, কৌতূহল আছে। স্বর্গের ঈশ্বরী নেমে এসেছিলেন তাঁদের জন্যে এবং এই ধরনের একটা প্রাসাদ কোন অ্যাটলে আছে? গুরুজি এটা সত্যিই বিস্ময়ের। আমি বলেছিলাম।
স্রষ্টা ঈশর কি তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসবেন না?
সৃষ্টির কান্না কি স্রষ্টার মন গলাবে না? তিনি কি সৃষ্টির অশ্রু মুসাতে আসবেন না? অবশ্যই আসবেন। রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি শাবানুর ক্ষেত্রে তিনি এসেছিলেন। রাজপুত্র হেসানা সাগরকন্যা শাবানুর জন্যে রাজ্য রাজত্ব সবই ছেড়েছিলেন। প্রশান্ত মহাসাগরে এই অ্যাটল রাজ্যে তিনি অবিরাম কেঁদেছেন এবং ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি সব ভুলেছিলেন, ভুলেন নি শুধু সাগরকন্যার প্রেম। স্রষ্টা দেখেছিলেন তাঁর সৃষ্টি এই রাজপুত্র সাগরকন্যাকে না পেলে সাগরেই তাঁর জীবন শেষ করে দিবে। এই অবস্থায় স্রষ্টা ‘হিনা’ তাঁর সৃষ্টির চোখ মুসাতে না এসে পারেন? তাই তিনি এসেছিলেন। তিনি আদর করে তাঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন ‘মু’ মহাদেশের ধ্বংসাবশেষ অ্যাটল দ্বীপের সেই প্রাসাদে। সেখানেই তাঁদের মিলন ঘটেছিল। স্রষ্টা হিনা তাঁর সৃষ্ট দুই মানব-মানবীর পাগলপারা প্রেমে মুগ্ধ হয়ে খুলে দিয়েছিলেন ধ্বংসপ্রাপ্ত এক মহাদেশের স্মৃতিবাহী সুন্দর প্রাসাদটিকে।আমার অস্তিত্ব যেমন সত্য, তোমার অস্তিত্ব যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই ঘটনা।
কথা শেষ করে সন্ন্যাসী আবার শুয়ে পড়েছিলেন। শুয়ে থেকেই বললেন, তরুন সন্ন্যাসী বেটা, তোমাকে আরও বলি এই অধমকেও স্রষ্টা হিনা দয়া করে সেই প্রাসাদটি দেখিয়েছিলেন। এই চর্ম চোখে আমি তা দেখেছি।
বলে থেমেছিলেন গুরু সন্ন্যাসী মুহূর্তের জন্যে। তারপর আবার শুরু করেছিলেন, তোমার মত আমার মনে প্রাসাদের অস্তিত্ব নিয়ে বিস্ময় ছিলনা বটে, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য এক আকুতি ছিল আমার ঐ প্রাসাদটি দেখার জন্যে। এই আকুলতা নিয়ে আমি অবিরাম ঘুরে ফিরেছি অ্যাটল থেকে অ্যাটলে দিনের পর দিন। একদিন সন্ধ্যায় তাহানিয়া অ্যাটলের পাশ দিয়ে মাকাতিয়া দ্বীপে ফেরার সময় প্রবল ঝড়ের মুখে পড়ল আমার ছোট বোটটি। এ অঞ্চলে ঝড় হয় না। যদি কখনও হয়, তাহলে তাকে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতিফলন মনে করে যে যেখানে থাকে সে সেখানেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর ঝড় সম্পূর্ণ থেমে গেলে আবার জীবন-কর্ম শুরু করে। সে অনুসারে আমি তাহানিয়া অ্যাটলে আমার ছোট বোটটি বেধে সেখানেই অপেক্ষা করলাম। অস্থির সাগরের ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখলাম। মঙ্গলময় মমতাময় স্রষ্টা হিনা কিংবা তাঁর পাঠানো কোন স্বর্গীয় অ্যাঞ্জেল আমার কাছে এলেন। আলোয় ঢাকা তাঁর দেহ কিংবা বলা যায় আলোর এক অবয়ব তিনি। আমাকে বললেন, এসো মানব, আমার সাথে এসো। আমি উঠলাম, তাঁর পেছেনে পেছনে চললাম। বোঁট থেকে নেমে তাহানিয়া অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্ত থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর এক যায়গায় দাঁড়ালো জ্যোতির্ময় অবয়ব। তাকাল মাটির দিকে। আমিও তাকালাম। সেখানে দেখলাম সফেদ ফুলের একগুচ্ছ গাছের ছোট্ট ঝোপ। জ্যোতির্ময় অবয়বটি মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ইচ্ছায় ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’ এর ‘সিঁড়িমুখ’ বের হলো। সংগে সংগেই ফুলের গাছের ঝোপটি অদৃশ্য হয়ে গেল। সেখানে মাটির নিচে কিছু একটা দেখা গেল। গোলাকার সফেদ পাথর। আবার বলল জ্যোতির্ময় অবয়বটি, সর্বশক্তিমানের ইচ্ছায় আমাদের পথ ছাড়ুন। কথার সাথে সাথেই পাশের মাটির ভেতরে হারিয়ে গেল সফেদ পাথরটি। সুন্দর সিঁড়িমুখ বের হয়ে পড়ল। সিঁড়িও সফেদ পাথরের। সেই সিঁড়িপথে ঢুকে গেলাম ভেতরে জ্যোতির্ময় অবয়বের সাথে। আসলেই ওটা প্যালেস। সম্মোহিতের মত আমি দেখেছি প্রাসাদটা। আয়তনে অনেক বড়, ছোট-খাটো একটা দ্বীপের সমান, তেমনি উচুর দিক দিয়ে কয়েক তলা হবে। এখানেই রাজপুত্র হেসানা ও সাগরকন্যা ভাইমিতি ছিল? বলেছিলাম স্বাগত কণ্ঠে। জ্যোতির্ময় অবয়বের অ্যাঞ্জেল জবাবে বলেছিল, হ্যাঁ, এখানেই তাঁরা ছিল, এটাই ছিল তাঁদের বাড়ি। যতটা সম্ভব মানুষের কল্যান তাঁরা করেছে। কখন আমার প্রাসাদ দেখা শেষ হল আমি জানিনা। যখন আমার ঘুম ভাঙল, দেখলাম ভোর হয়ে গেছে। একটা স্বস্তি যেন আমার দেহে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে। মনের মধ্যে একই কথা বার বার ঘুরে ফিরে আসতে লাগল, স্বপ্নটা আমার কি সত্যি। সত্যিই কি অ্যাঞ্জেল এসেছিল আমার কাছে। প্রাসাদ কি আমি দেখেছি তাঁর সাথে গিয়ে, সত্যিই কি তাহলে প্রাসাদ আছে। সকাল হতেই আমি বোঁট থেকে নেমে অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্ত ধরে দক্ষিনে এগোতে থাকলাম। এখানে অ্যাটলের পশ্চিম প্রান্তটি প্রশস্ত। যতই দক্ষিনে গেছে আরও প্রশস্ত হয়েছে। আমার চোখ সন্ধান করছিল সেই সফেদ ফুলের গাছের ঝোপ। পেয়ে গেলাম সফেদ ফুলের সেই ঝোপ। আমি বিস্মিত ও সম্মোহিতের মত দাড়িয়ে পড়লাম সফেদ ফুলের গাছের সেই ঝোপের পাশে। আমার গোটা শরীর রোমাঞ্চিত হলো। তাহলে স্বপ্ন আমার সত্য, অ্যাঞ্জেল সত্য, প্রাসাদও সত্য। আমি ছুটে গিয়ে বোঁট থেকে শাবল নিয়ে এলাম। সফেদ ফুলের গাছের ঝোপের পাশে গর্ত আকারে খুড়তে লাগলাম। মাটির দু’হাত গভীরে যাবার পর সত্যিই পেলাম স্বপ্নে দেখা সেই সফেদ পাথর। তাঁর মানে পাথর তুললেই সিঁড়ি। সিঁড়ির পড়েই সেই প্রাসাদ। সবই আমি পেয়ে গেলাম। প্রাসাদে ঢুকতে মন চায়নি। চাল-চুলাহীন সন্ন্যাসী, তাঁর তো প্রাসাদ দরকার নেই। যা দেখার সেটা তো অ্যাঞ্জেল আমাকে দেখিয়েছেন। গর্ত মাটি ঢেলে বন্ধ করে চলে এসেছিলাম। আর যাইনি। বলল তরুন সন্ন্যাসী, ‘মু’ মহাদেশের অবশিষ্ট স্মৃতি সেই প্রাসাদ সম্পর্কে আর জিজ্ঞাসা আছে? সৃষ্টির অশ্রু মোছাতে স্রষ্টা যে আসেন কিংবা সৃষ্টির আন্তরিক চাওয়া মেটাবার ব্যবস্থা করেন, সে বিষয়ে কোন বিস্ময় এখনও আছে?
গুরুজি একটি বিষয়, রাজপুত্র হেসানা সম্পর্কে আমার কোন কথা নেই। কারন সে পাপেতি রাজবংশের রাজকুমার আমরা জানি। কিন্তু ‘সাগরকন্যা’ তো বাস্তব নয়। বললাম আমি।
সন্ন্যাসী বলল, জানা গেছে, সে একটা জাহাজ ডুবির ফল। তোয়ামতু দ্বীপপুঞ্জ উত্তর পাশ দিয়ে গুয়েতেমালার দিকে যাবার পথে একটা জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে। পরে জানা গেছে, জাহাজটি পশ্চিম এশিয়ার কোন এক আরব দেশের। জাহাজ থেকে আর কেউ বেঁচেছে কিনা জানা যায়নি, তবে একজন শিশুকন্যা বেঁচেছিল। শিশুকন্যাটি একটা ডলফিনের পিঠে ভাসছিল। ডলফিন গিয়ে ভেড়ে পলিনেশীয়ার কোন দ্বীপে। সে দ্বীপেরই বনচারী, সাগরচারী একটা পরিবার শিশুকন্যাকে ডলফিনের পিঠ থেকে নিয়ে নেয়। তারাই তাঁর নাম রাখে ভাইমতি বা সাগরকন্যা। আর তাঁর গলার লকেটে পাওয়া নামের পাঠোদ্ধার করে সেটা এভাবেই এসেছে। শিশু ভাইমতি শাবানু একদিন বড় হয়। বন ও সাগর হয় তাঁর বাধা-বন্ধনহীন বিচরনের ক্ষেত্র। পাখির মতই সে ঘুরে বেড়ায় বনে ও সাগরে। সাগরকন্যা শেষ পর্যন্ত সাগরকন্যাই হয়ে যায়। এই সাগরকন্যার সাথেই একদিন দেখা হয় সাগরচারী রাজপুত্র হেসানা হোসানার সাথে। প্রথম দর্শনেই স্রষ্টার ইচ্ছায় তাঁরা একে অপরের হয়ে যায়। এই কাহিনী আমি শুনেছি পূর্ব তাহিতির এক বৃদ্ধ জেলের কাছে। আমি নিশ্চিত, এই কাহিনির মধ্যে কোন অতিরঞ্জন নেই। বিকল্পও নেই এই কাহিনীর। থামল একটু গুরু সন্ন্যাসী। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, তরুন সন্ন্যাসী বল, আর কোন কথা, আর কোন প্রশ্ন?
আমি বললাম, না, আর কোন প্রশ্ন নেই গুরু সন্ন্যাসী। আমি চলে এসেছিলাম গুরুজির কক্ষ থেকে।
তারপর এক সময় আমিও গিয়েছিলাম তাহানিয়া দ্বীপে সেই সফেদ ফুল গাছের ঝোপের সন্ধানে। সেই ঝোপ পাইনি। ঝোপ না পাওয়ায় আমার আগ্রহ কৌতূহল বেড়ে গিয়েছিল, পাথর ও প্রাসাদ ঐভাবে আছে কিনা তা দেখার জন্যে। অনেক দিনের অনেক খোঁজাখুঁজি, অনেক খোঁড়াখুঁড়ির এক রাতের শুভ ভোঁরে দু’হাত মাটির গভীরে পেয়ে গেলাম সেই গোলাকার সফেদ পাথর। পাথর পাওয়ার সাথে সাথে আমার গুরু সন্ন্যাসীর মত সব পাওয়া হয়ে গেল। সফেদ পাথর সরিয়ে ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ারে’ প্রবেশ করতে মন চায়নি। ঘর-দোর ছাড়া পথের সন্ন্যাসী প্রাসাদ দিয়ে কি করব। যে কৌতূহল ছিল সেই কৌতূহল মিটিয়ে চলে এসেছি। থামল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
আমি গোগ্রাসে যেন গিলছিলাম তাঁর কথা এবং তাঁর গুরু সন্ন্যাসীর কথা। মনে হছিল আমি যেন, স্বর্গের চাবি পেয়ে গেছি। আমি অ্যাটল দ্বীপপুঞ্জে গত তিন দিন ধরে যা খুজছিলাম, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি যেন পেয়ে গেছি। আনন্দ উত্তেজনায় মনে হল হার্টবিট আমার বেড়ে গেছে!
কথা শেষ করে বৃদ্ধ সন্ন্যাসী পাথরের বেঞ্চির উপর গা এলিয়ে দিয়েছে। চোখ বুজে গিয়েছে তাঁর।
আমিও কোন কথা বললাম না।
নীরব আমরা। বয়ে চলল সময়। এক সময় চোখ খুলল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
তাকাল আমার দিকে। বলল বৎস ‘প্যালেস অফ ওয়েলফেয়ার’ তোমার কাজে লাগবে। সৃষ্টির উপর গবেষণা ভালো জিনিস। এটা হয় মানুষের মঙ্গলের জন্যেই। অতএব, তুমি প্যালেস অব ওয়েলফেয়ারের সদ্ব্যবহার করতে পারবে। তুমি যেমন চাও প্রাসাদটি সে রকমই। থামল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
স্বর্গ যেন কেউ আমার হাতে তুলে দিল।
আমি উঠে গিয়ে সন্ন্যাসিকে আভূমি প্রণাম করে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পা ছুয়ে বললাম, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার এই দানের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমার নেই।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী দু’হাত জোর করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলল, সন্ন্যাসীদের জন্যে কোন কৃতজ্ঞতা নেই। কৃতজ্ঞতা সব ঈশ্বরের জন্যে।
বলে আবার চোখ বুজল বৃদ্ধ সন্ন্যাসী। চোখ বুজে থেকেই বলল, যাও বৎস, ঈশ্বরের সম্পদ ঈশ্বরের জন্যে ব্যবহার কর। আমাদের হারানো ‘মু’ মহাদেশের রাজন্যদের ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’-এর যথার্থ ব্যবহার কর। ঈশ্বরের মত ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালবাস। তাহলে তাঁর রোষের মুখোমুখি তোমাকে কোনদিন হতে হবেনা।
আরও কোন নসিহত শোনার ভয়ে তাড়াতাড়ি তাকে একটা প্রণাম করে আমি চলে এলাম।
সুদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেটের সুপ্রিম বস আলেক্সি গ্যারিন।
বৈঠকে উপস্থিত পাঁচ শীর্ষ নির্বাহীসহ চীপ অব অপারেশন জিজর, গোয়েন্দা প্রধান ডারথ ভাদের ও গৌরী পিনপতন নিরবতার মধ্যে আনন্দ, বিস্ময় ও কৌতূহলের সাথে আলেক্সি গ্যারিনের কথা শুনছিল। আলেক্সি গ্যারিনের কথা শেষ হলেও শ্রোতাদের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। বাস্তব ঘটনা যে রুপকথার চেয়েও বিস্ময়কর হতে পারে, এ কাহিনী তারই প্রমান।
আলেক্সি গ্যারিন দীর্ঘ কথা শেষ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। তবে শীঘ্রই সোজা হয়ে বসল। বলল, কাহিনী একটু দীর্ঘ হলেও তা তোমাদের বললাম, কিভাবে এই ঐতিহাসিক রাজকীয় প্যালেস পেলাম আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ প্রতিষ্ঠার জন্যে। ঈশর দিবে আমি বিশ্বাস করিনা। আমাদের প্রাপ্য বলে আমরা এটা পেয়েছি। বলে একটু থামল। মুহূর্ত কয়েক পর আবার শুরু করল, ঐতিহ্য ও নীতি-নৈতিকতায় আমি বিশ্বাস করিনা। সে জন্যই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী যে নীতি- নৈতিকতার উপদেশ আমাকে দিয়েছিলেন তা রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁদের প্রিয় ‘মু’ মহাদেশের রাজকীয় প্রাসাদের অংশ ‘প্যালেস অব ওয়েলফেয়ার’ বলে কথিত প্রাসাদটিই আজ আমাদের ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’।
ওয়েলফেয়ার কি জন্যে? ওয়েলফেয়ার প্রয়োজন দুর্বলদের। দুর্বলদের জন্যে আমাদের কিছু করার নেই বরং আমরা দুনিয়ার সবাইকে দুর্বল বানাতে চাই। শুধু সবল থাকবে, শক্তিশালী ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট ও সকল ক্ষমতার কেন্দ্র হবে আমাদের এই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে আলেক্সি গ্যারিন আবার বলল, বহু কষ্টে আমাদের এই ‘ক্যাপিটাল অব পাওয়ার’ আমরা পেয়েছি। এর নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ প্রাইওরিটি। আহমদ মুসা কোন মিশন নিয়ে এখানে এসেছে আমি জানিনা। কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর সাথে লড়াই শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য সে আমাদের চিনেছে, জেনেছে তাঁর কোন প্রমান আমি পাইনি। তবে তাঁর সাথে আমাদের সংঘাত শুরু হওয়ায় ধরে নেয়া যায় তাঁর মত বুদ্ধিমান লোক সবকিছুই জেনে যাবে।এটা অবধারিত ধরে নিয়েই আহমদ মুসাকে শেষ করার জন্যে সর্বান্তক চেষ্টা ও সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। বিপদ সম্পর্কে সবাইকে জানানো ও করনীয় ঠিক করার জন্যেই আজকের বৈঠকের আয়োজন। থামল আলেক্সি গ্যারিন।
একটু নিরবতা।
নিরবতা ভেঙ্গে বলল একজন শীর্ষ নির্বাহী, মাই লর্ড, আপনি যা বলেছেন সেটাই আমাদের করনীয়। শয়তানটাকে শেষ করার লক্ষ্যে সর্বান্তক চেষ্টা ও সর্বশক্তি নিয়োগ করা।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে চীপ অপারেশন জিজর, গোয়েন্দা প্রধান ডারথ ভাদের ও গৌরীকে নিয়ে তিন সদস্যের একটি অপারেশন টীম গঠন করা হলো। এই টীম যাবতীয় উপায়-উপকরন ব্যবহার করবে এবং আহমদ মুসাকে খুঁজে বের করে, তাকে সার্বক্ষণিক নজরে রেখে যতটা সম্ভব শীঘ্রই তাকে শেষ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে তাঁর লাশও কিন্তু আমাদের পেতে হবে। সুযোগ পেলে কিংবা সুযোগ সৃষ্টি করে দেখামাত্র তাকে হত্যা করার চেষ্টা করতে হবে।
সবাই মাথা নাড়ল। কিন্তু মাথা নাড়তে পারল না গৌরী।
একটা চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
কি দোষ আহমদ মুসার? তাকে আমরা কিডন্যাপ করতে গেছি। সেটা করতে গিয়ে আমাদের পাঁচজন মরেছে। সে তো আত্নরক্ষা করেছে মাত্র! সে তো আমাদের আক্রমন করেনি। তাহলে দেখামাত্র গুলী কেন? তাকে না দেখলে, তাঁর ভেতরটা না জানলে এ প্রশ্ন তাঁর মনে হয়ত আসতো না। লাশ নেবে কেন আর তাঁর লাশ ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট বিক্রিই বা কেন করবে?
এসব নানা কথা, নানা প্রশ্ন গৌরীকে বিমূঢ় করে দিয়েছিল। তাই তাঁর লর্ড আলেক্সি গ্যারিনের কথায় সে সায় দিতে পারেনি।
টিমের কাজ শুরু হবে আজ এই মুহূর্ত থেকে। গুড নাইট সকলকে। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
আলেক্সি গ্যারিনের কথা শেষ হবার সংগে সংগেই ফ্লোরের ভেতরে থেকে কালো টিউব উঠে এল। আলেক্সি গ্যারিনের চেয়ারের চারদিক ঘিরে দেয়ালের মত উঠে এল টিউবটা। উঠে চলল ছাদ ফুঁড়ে উপরে।
বৈঠকের সবাই উঠে বাউ করে দাঁড়িয়েছিল।
টিউব-লিফট উপরে অদৃশ্য হয়ে গেলে শীর্ষ নির্বাহী পাঁচজনের একজন গৌরীকে লক্ষ্য করে বলল, আমরা উঠতে পারি, ম্যাডাম গৌরী?
গৌরী আলেক্সি গ্যারিনের পিএ এবং আলেক্সি গ্যারিনের ব্যক্তিগত বাহিনীর কমান্ডার হলেও আলেক্সি গ্যারিনের অনুপস্থিতিতে সেই তাঁর প্রতিনিধিত্ব করে। আলেক্সি গ্যারিনের পার্সোনাল সেক্রেটারিয়েটও গৌরী দেখে। ফলে উপরের সবার চেয়ে গোপন বিষয় সে বেশি জানে। আরেকটা বিষয়ও সকলে ওপেন সিক্রেট আকারে জানে এবং সেটা হলো, গৌরী আলেক্সি গ্যারিনের স্ত্রী নয় তবে ডি-ফ্যাকটো স্ত্রী হিসাবে রয়েছে। এই বিষয়টি গৌরীর জন্যে খুবই স্পর্শকাতর। পরোক্ষভাবেও গৌরী কোন সময় এ ধরনের কথার মুখোমুখি হলে খুবই রিঅ্যাক্ট করে। এমন ক্ষেত্রে লুকিয়ে তাকে কাঁদতে দেখা গেছে। কিন্তু ব্ল্যাক সানের শীর্ষ পর্যায়ের সবাই এক সময়ের পূর্ব মার্লিন এলাকার রুশ বংশোদ্ভূত মেয়ে গৌরীকে সমীহ করে চলে। গৌরী যেমন অসম্ভব সুন্দরী, তেমনি সাহসী, বুদ্ধিমতি, ক্ষিপ্র ও দারুন উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। Rise and fall of the dynasties of the world, বিষয়ের উপর পিএইচডি গৌরীর। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর অধ্যাপনা করার কথা ছিল। কিন্তু গৌরী প্রকৃতিগতভাবে সাহসী ও বেপরোয়া বলেই সাজানো একটা খুনের মামলার আসামী হয়ে তাকে পলাতক হতে হয়। এই অবস্থায় ব্ল্যাক সান সিন্ডিকেট তাকে রিক্রুট করে। সাহস, মেধার জোরেই সে ব্ল্যাক সানের শীর্ষ পর্যায়ে উঠেছে।
মাই লর্ড চলে গেছেন। মিটিং শেষ হয়েছে। আপনারা অবশ্যই যেতে পারেন। বলল গৌরী।
এখনই একটা মিটিং সেরে ফেলতে পারি।বলল জিজর।
ঠিক। মাই লর্ড তো এখন থেকেই কাজ শুরু করতে বলেছেন। ডারথ ভাদের বলল।
এ ধরনের মিটিং-এর জন্যে প্রস্তুতি দরকার। তবে একটা প্রাথমিক আলোচনা হতে পারে। বলল গৌরী।
পাশের আরেকটা কক্ষের একটা গোল টেবিল ঘিরে বসে তাঁরা আলোচনা শুরু করল।
মিটিং চলল প্রায় একটা ঘণ্টা।
মিটিং শেষে বেরিয়ে আসার সময় গৌরী হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত ৪টা। হাসল গৌরী। তাঁদের সব কাজ রাতেই। নামটা তাঁদের সার্থক।
গৌরী তাঁর কক্ষে যাবার জন্যে এলিভেটরে উঠতে যাচ্ছিল। তাঁর মোবাইল বেজে উঠল। থমকে দাঁড়ালো গৌরী।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দেখল স্বয়ং তাঁর লর্ডের কল। তাড়াতাড়ি সাড়া দিয়ে বলল, ইয়েস মাই লর্ড, কোন হুকুম?
তুমি এখনই একটু আমার বাংলোতে চলে এস। বলল আলেক্সি গ্যারিন।
অস্বস্তি, একটা অসহায়ত্ব যেন ছায়া ফেলল গৌরীর চোখে-মুখে। কিন্তু মুহূর্তেই তা মিলিয়ে গেল। বলল, ইয়েস মাই লর্ড, আমি আসছি।
বলে গৌরী অন্য একটি বিশেষ এলিভেটরে উঠল। সংগে সংগেই তা চালু হয়ে গেল। এ এলিভেটর সরাসরি গেছে আলেক্সি গ্যারিনের বেডরুমে। এ এলিভেটর তাঁর ইচ্ছাতেই মাত্র চলে। | ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »
Top