৫১. প্যাসেফিকের ভয়ংকর দ্বীপে

চ্যাপ্টার

আহমদ মুসাদের গাড়ি যখন সে সুপার মার্কেটের কারপার্কিং-এ প্রবেশ করছিল, তখন ওরা তিনজনে ধরে মাহিনকে চ্যাং দোলা করে গাড়িতে তুলছিল।
আহমদ মুসা মাহিনকে গাড়িতে তুলতে দেখল। বুঝল মারেভাকে আগেই গাড়িতে পুরা হয়েছে। মারেভার চিৎকারও শোনা যাচ্ছে।
মারেভা ও মাহিনের ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার চারদিকের পরিবেশকে সত্যিই আতংকিত করে তুলেছে। আসলেই তারা অভিনয় করছে না, আতংকগ্রস্ত হয়ে বাঁচার জন্যে চিৎকার করছে। নিখুঁত অভিনয় ও বাস্তব আচরণের মধ্যে আসলেই বোধ হয় কোন পার্থক্য নেই।
তাদের চিৎকারে সুপার মার্কেটের সামনে অনেক লোক জমেছে। মার্কেটের ভেতর থেকেও লোক বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কেউ কিছু করছে না। তাদের দিকে ষ্টেনগান তাক করে আছে কিডন্যাপারদের সহচর একজন। তারা আগে ফাঁকা গুলিও ছুঁড়েছে। তাতেই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সকলে।
গাড়ি থামতেই আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নামল। তার ডান হাতে রিভলবার।
বের হয়েই আহমদ মুসা বিরভলবার তুলল ষ্টেনগানধারীর উদ্দেশ্যে। বলল, ষ্টেনগান ফেলে দাও। আমি এক আদেশ দু’বার দেই না।
ষ্টেনগানধারী চরকির মত বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল। তার ষ্টেনগানের নলও ঘুরে এল আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। তারও আঙ্গুল ষ্টেনগানের ট্রিগারে।
আহমদ মুসা আত্মরক্ষার জন্যে মুহূর্তও সময় নষ্ট করেনি। ঠিক সময়েই তার তর্জনি চেপে বসেছে ট্রিগারে। ষ্টেনগানধারীর ষ্টেনগানের নলের গা ঘেঁষে বুলেটটি লোকটির বাঁ বুকে গিয়ে বিদ্ধ হলো।
যারা মাহিনকে গাড়িতে ঢুকাচ্ছিল, তারাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার তাদের গুলিবিদ্ধ সাথীর দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত পকেট থেকে রিভলবার বের করেছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তারা আহমদ মুসার টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
আহমদ মুসা ষ্টেনগানধারীকে গুলি করেই ওদের তিনজনকে টার্গেট করেছে। ওদেরকে রিভলবার বের করতে দেখে আহমদ মুসা বলল, তোমরা রিভলবার ফেলে দাও, তা না হলে তোমাদেরকেও এই সাথীর মত…।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। ওদের রিভলবার তাকে টার্গেট করে উঠে আসছে দেখে আহমদ মুসা রিভলবারের ট্রিগার টিপে দিল পর পর তিনবার। কিন্তু সর্ববামের লোকটির ক্ষেত্রে টার্গেট মিস হলো। তার বাম কাঁধে গুলি লাগল। সে গুলি চালাবারও সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু আহমদ মুসার গুলি গিয়ে আঘাত করল আহমদ মুসার বাম বাহুসন্ধির উপরের অংশে। অদ্ভুত ষ্ট্যামিনা লোকটির! নিজের গুলিবিদ্ধ কাঁধের দিকে কোন খেয়াল নেই তার। প্রথম গুলিটা টার্গেটে লাগেনি দেখে রিভলবারসমেত তার ডান হাত উঠে আসছিল আহমদ মুসার লক্ষে।
কিন্তু আহমদ মুসা তা হতে দিল না। তার রিভলবার এই তৃতীয় টার্গেটের দিকে তাক করাই ছিল। শুধু ট্রিগার টেপার বাকি। ট্রিগার টিপে দিল সে। আহমদ মুসার লক্ষ এবার ছিল লোকটির ডান হাত।
ওদের একজনকে জীবন্ত ধরার প্রয়োজন ছিল খুব বেশি। কিন্তু সে সুযোগ এ পর্যন্ত হয়নি। এবারের সুযোগটিকে সে কাজে লাগাল।
আহমদ মুসার গুলি গিয়ে লোকটির একবারে কবজিতে বিদ্ধ হলো। তার হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল।
লোকটি সাংঘাতিক বেপরোয়া!
রিভলবারটি গুলিবিদ্ধ ডান হাত থেকে খসে পড়ার সাথে সাথে সে বসে পড়ল এবং বাম হাত দিয়ে রিভলবারটি তুলে নিল।
তার গুলিবিদ্ধ ডান কাঁধের অসম্ভব যন্ত্রণা সে উপেক্ষা করে রিভলবার বাম হাতে তুলে নিয়ে আহমদ মুসাকে টার্গেট করার চেষ্টা করল।
তার রিভলবার উঠে আসছিল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা নিরুপায়। গুলি করে লোকটির বাম হাতটা নিস্ক্রিয় করে দেয়াই আহমদ মুসার বাঁচার উপায়।
আহমদ মুসার রিভলবার লোকটির দিকে তাক করাই ছিল। ট্রিগার টিপল শুধু।
গুলিটি গিয়ে বিদ্ধ করল লোকটির ডান বাহুকে। রিভলবারসমেত তার বাম হাত আছড়ে পড়ল মাটিতে।
লোকটি সম্ভবত তার হতাশা ও ব্যর্থতায় মাটিতে শুয়ে পড়ল।
মাহিন ও মারেভা আগেই গাড়ির ওপাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। আতংকগ্রস্ত তাদের চোখ-মুখ। আহমদ মুসার বাম বাহুসন্ধিতে গুলি লাগতে দেখে দু’জনেই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিল, যেন গুলিটা তাদের লেগেছে।
গুলি বন্ধ হতেই মাহিন ও মারেভা দু’জন ছুটে গেল আহমদ মুসার কাছে।
ওদিকে সুপার মার্কেটের সামনের লোকরা গুলি শুরু হলে কেউ সুপার মার্কেটের ভেতরে সরে গিয়েছিল, কেউ সুপার মার্কেটের সিঁড়িতে শুয়ে বা বসে ছিল। গুলি বন্ধ হলে তারা সবাই বেরিয়ে এল। সবাই হাততালি দিয়ে কিডন্যাপিং থেকে মাহিন ও মারেভার উদ্ধার পাওয়াকে স্বাগত জানাল।
তেপাও এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়েছে।
তেপাও, মাহিন, তোমরা এস, লোকটিকে আমাদের গাড়িতে তোল। কুইক।
তেপাও মাহিনকে এ নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসা মারেভাকে বলল, তুমি তোমাদের ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে এস। ট্যাক্সিওয়ালাকে না পেলে টাকা তার ট্যাক্সির উপরে রেখে এস।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা হাততালি দেয়া উৎসুক, অপেক্ষমাণ লোকদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, প্লিজ, আপনারা শুনুন, আহত লোকটির অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তাকে অবিলম্বে হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। কিডন্যাপিং-এর শিকার তরুণ-তরুণীকেও এখানে রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। হতে পারে তাদের বিপদ এখনও কাটেনি। তাই তাদেরকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছি। পুলিশ এসে যাবে। আপনারা যা দেখেছেন, দয়া করে তা পুলিশকে জানাবেন। ধন্যবাদ সকলকে।
উপস্থিত লোকেরা হাততালি দিয়ে আহমদ মুসার কথার জবাব দিল।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল।
তেপাও সামনের বাঁক ঘুরে গাড়ি একটু দাঁড় করাবে। আহমদ মুসা বলল।
গাড়িটা বাঁকে এসে বাঁক ঘুরে একটা সেফ ল্যান্ডিং দেখে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা বন্ধ করে গাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। কল করল তাহিতির স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান ফরাসি পুলিশ সার্ভিসের প্রধান সেই অফিসারকে। মাহিন ও মারেভার কিডন্যাপিং নিয়ে যা যা ঘটল সংক্ষেপে আহমদ মুসা সব জানাল তাকে এবং বলল, আমি আহত লোকটিকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আসছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা আমার খুব জরুরি। এই প্রথম ওদের একজনকে জীবিত ধরা গেছে। তার কাছ থেকে কিছু কথা নেয়া আমার দরকার। কিন্তু আইন অনুসারে তাকে থানায় দেয়া দরকার অথবা হাসপাতালে নিয়ে পুলিশকে জানানো উচিত। আপনার পরামর্শ চাই স্যার।
মি. আহমদ মুসা, ঘটনাস্থলে কোন পুলিশ ছিল? বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান।
জি না। আহমদ মুসা বলল।
যে গাড়ি ব্যবহার করছেন, তা কোন পুলিশ নিশ্চয় দেখেনি। বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান।
দেখেনি। আহমদ মুসা বলল।
ঘটনাস্থলের লোকজন গাড়ির নাম্বার নিশ্চয় দেখেনি বা নেয়নি? জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধানের।
সেটা বলা মুশকিল স্যার। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে জানলেও ক্ষতি নেই। একটা কাজ করুন। আপনা গাড়ি এখন কোথায়? জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধানের।
অ্যাভেনিউ পোমা’তে উঠে পূর্ব দিকে যাচ্ছি। আমরা পাতোতোয়ার হোটেল প্যাসেফিক ইন্টারন্যাশনাল থেকে এসে পোমা সুপার মার্কেটটির পাশ দিয়ে অ্যাভনিউ পোমা’তে উঠেছি। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে। ভালোই হলো। আপনাদের সামনেই মায়েভা থানা। আপনার সাথে আর কয়জন আছে? জিজ্ঞাসা স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ প্রধানের।
আমাদের ড্রাইভার তেপাও, মাহিন ও মারেভা। আহমদ মুসা বলল।
আপনি গাড়িটা ছেড়ে দিন। ওরা আহত লোকটিসহ গাড়ি নিয়ে এগোক ধীরে ধিরে। আর আপনি অন্য একটি গাড়ি নিয়ে সোজা মায়েভা থানায় চলে যান। সেখানে সব ঘটনা খুলে বলুন এবং শেষে বলুন, আপনি গুলিবিদ্ধ আহত লোকটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছু দূর এগোবার পর একটি মাইক্রো আপনার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং আপনাকে আহত করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িশুদ্ধ আহত লোকটিকে নিয়ে গেছে। আপনি থানায় গিয়ে এই ডাইরিটি করুন। থানা সন্দেহজনকভাবে আপনাকে কিছু করতে আসবে না। আমিও মিনিট পনের পরে থানায় টেলিফোন করব। থানা থেকে বেরিয়ে তারপর আহত লোকটিকে নিয়ে কোন নিরাপদ স্থানে চলে যান। আপনার প্রয়োজন পূরণে যা ইচ্ছা তাই করুন।
বলে থামল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান। মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে আবার বলল, সেরকম নিরাপদ জায়গা আছে আপনাদের?
সে রকম নেই। তবে ব্যবস্থা একটা করে ফেলব। আহমদ মুসা বলল।
না, তার দরকার নেই। আপনাকে অত কষ্ট করতে হবে না। আপনি আহত লোকটিকে নিয়ে সোজা আমার এখানে চলে আসুন। এখানে আন্ডারগ্রাউন্ডে আমাদের একটা সেল আছে। আপাতত সেটা আপনারা ব্যবহার করবেন। বলল স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশপ্রধান।
ধন্যবাদ স্যার। আমরা আসছি। আহমদ মুসা বলল।
ওয়েলকাম। আসুন, কথা আপাতত শেষ। গুড বাই আহমদ মুসা। বলে ওপার থেকে কল অফ করে দিলেন।
কল অফ করে আহমদ মুসা ডাকল মাহিনকে।
মাহিন তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আহমদ মুসার কাছে যেতেই সে মাহিনকে নিয়ে গাড়ি থেকে একটু দূরে সরে গেল। তাকে সব কথা বুঝিয়ে বলল। সব কথা শুনে মাহিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, এই সময়ের জন্যে এর চেয়ে ভাল সলিউশন আর হয় না স্যার।
হ্যাঁ মাহিন, তুমি ঠিক বলেছ। ঠিক আছে মাহিন। যেভাবে বলেছি, সেভাবে কাজ করবে।
বলে আহমদ মুসা গাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, মারেভা, আমি একটু অন্য জায়গায় যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরব। তোমরা চলতে থাক।
মাহিন উঠে বসেছে গাড়িতে।
গাড়ি তাদের চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসা একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসে বলল, সামনে মায়েভা থানায় চল।
জি স্যার, বলে ট্যাক্সি ড্রাইভার তার গাড়িতে ষ্টার্ট দিল।

আহত লোকটির তিনটি ক্ষত স্থানেই ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল আহমদ মুসা খুব যত্নের সাথে। গুলিবিদ্ধ তিন জায়গার কোনটাতেই বুলেট নেই। ঘাড়ের আঘাতটাই বেশি গভীর। কিন্তু সেখানেও বুলেট নেই। ঘাড়ের কিছু গোশত ছিঁড়ে নিয়ে বুলেট বেরিয়ে গেছে।
| ← Previous | | | Next → | | সম্পুর্ণ বই এক পেজে »

Top