১
‘বল তোকে ওয়াশিংটন ছাড়তে বলা হয়েছে, আমেরিকার ছাড়তে বলা হয়েছিল, ছাড়িসনি কেন?’ কথাগুলো বলতে বলতে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে দৈত্যাকার একজন লোক ঘুষি ছুড়ে মারল সান ওয়াকারের মুখে
মেঝের উপর ছিটকে পড়ে গেল সান ওয়াকারের দেহ। ঠোঁটে ফেটে ঝর ঝর করে রক্ত বেরুল।
কপালটাও তার থেঁতলে যাওয়া। মনে হয়। ভোতা জিনিস দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। মেঝের উপর দের ফুট লম্বা একটা ব্যাট পড়ে আছে। ওটারও আঘাত হতে পারে।
লোকটা আঘাত করে গিয়ে চেয়ারে বসল। দৈত্যাকার বপু এ লোকটার নাম গ্রিংগো। সে হোয়াইট ঈগলের ওয়াশিংটন হেড অফিসে টর্চার ইউনিটের সবচেয়ে কার্যকর হাত।
তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে খুনি আকৃতির ষন্ডা মার্কা আরো দু’জন লোক।
ঘুষি খেয়ে পড়ে যাবার পর ধীরে ধীরে উঠে বসল সান ওয়াকার। বলল, ‘কিন্তু আমি ওয়াশিংটন ছাড়ব কেন, আমিরিকা ছাড়ব কেন? আমার দোষ কি?
‘দোষ কি আবার জিজ্ঞেস কা হচ্ছে! ন্যাকা, যেন কিছুই বোঝে না’।
বলে গ্রিংগো একটু থামল। শুরু করল আবার, ‘তুই মেরী রোজকে বিপদগামী করেছিস। তোর কারণেই মেরী রোজ আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।’
‘মিথ্যে কথা। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবার বয়স রোজ-এর হয়েছে। এবং সে বুদ্ধি তার আছে।’ কপাল থেকে চোখের উপর দিয়ে গড়িয়ে আসা রক্ত মুছতে মুছতে সান ওয়াকার বলল।
‘এসব কেতাবী কথা রাখ। সব আমরা বুঝি। ‘বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে সান ওয়াকারের পাঁজরে একটা সজোরে লাথি কষে আবার গ্রিংগো মুখ বাকিয়ে বলল, ‘আহা! প্রেম করেছে। ব্লাডি ব্লাক হয়ে শ্বেতাংগিনী রোজ-এর দিকে হাত বাড়াবার মাজা এবার পাইয়ে দেব।’
সান ওয়াকার কিছুই বললনা। সে জানে এসব প্রলাপ, হিংসার অস্ত্র। জবাব দেবার কিছু নেই।
কিন্তু সান ওয়াকারেরর নীরবতা গ্রিংগোকে ক্ষেপিয়ে তুলল। বলল সে গর্জে ওঠে, ‘বল হারামজাদা ওয়াশিংটন এবং আমেরিকা ছাড়ছিস কিনা!’
আমি এমন কিছু করিনি যে আমাকে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজের দেশ ছাড়তে হবে।’ বলল সান ওয়াকার শান্ত ও দৃঢ় কণ্ঠে।
জ্বলে উঠল যেন গ্রিংগোর মুখ। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। বলল চিrকার করে, ‘দেশ ফলানো হচ্ছে! কোথায় তোর দেশ? আমেরিকা? এখানো তেআ পরাজিত হয়েছিস। উrখাত হয়েছিস এখান থেকে। তোদের সবাইকে পালাতে হবে যদি বাঁচতে চাস।’
‘আমেরিকা ও আমেরিকান জনগণের কথা নয়। আর পালাব কেন? সবার মত আমরাও আমেরিকান।’
‘গোল্লায় যাক তোর আমেরিকান আইন আর জনগণ। আমরা শ্বেতাংগরা নতুন আইন করেছি আমেরিকায়। তোরা এশিয়া থেকে এসেছিস, এশিয়ায় ফিরে যেতে হবে।’
‘কিন্তু আপনারা এসেছেন ইউরোপ থেকে আমাদের পরে।’
‘কিন্তু আমরা জিতেছি। আমেরিকা এখন আমাদের।’
‘আমেরিকান জনগণ এটা মানবে না।’
‘গোল্লায় যাক জনগন। তোর জনগণ মানে তো হোয়াইট, নন হোয়াইট সব। আমরা এ জনগণ তত্ত্ব মানি না। আমরা জনগণের বাপ। আমরা যা বলব তাই হবে।’
বলে একটা ঢোক গিলেই আবার বলল, ‘বল, দেশ ছাড়ছিস কিনা?’
‘না’ আমি দেশ ছাড়ছি না। তাছাড়া আমি ছাত্র, আমি লেখাপড়া করছি এখানে।’ শক্ত কণ্ঠে বলার চেষ্টা করল সান ওয়াকার।
‘কি এত বড় স্পর্ধা! শিক্ষা তাহলে তোর এখনও হয়নি।’ বলে গ্রিংগো সান ওয়াকারের কাছে ছুটে গিয়ে পাঁজরে একটা লাথি চালিয়ে পা দিয়ে মেঝেয় ঢলে পড়া সান ওয়াকারের গলা চেপে ধরে বলল, ‘তুই স্টুডেন্ট নোবেল প্রাইজ’ পেয়েছিস। তোকে আর বাড়তে দেয়া যায় না। তোকে মরতে হবে। তোকে বাইরে পাঠানোর প্রস্তাব ছিল আমাদের একটা উদারতা।’
সান ওয়াকারের শ্বাস রুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। তখন চিrকার করে বলছিল গ্রিংগো, ‘বল হারামজাদা, স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়বি কিনা?’
ঠিক এই সময় ঘরে প্রবেশ করল হোয়াইট ঈগল-এর প্রধান গোল্ড ওয়াটার-এর ডিপুটি জর্জ আব্রাহাম।
ঢুকে গ্রিংগোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গ্রিংগো মেরে ফেলো না। মুল্যবান লোক ও। অনেক জানার আছে তার কাছ তেকে। ছেড়ে দাও ওকে।’
গ্রিংগো সরে দাঁড়াল।
জর্জ আব্রাহাম সান ওয়াকারের হাত ধরে টেনে তুলে বসাল। বলল, ঈগল সান ওয়াকার আমরা দুঃখিত এজন্য যে, তোমার উপর এসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে।’
বলে জর্জ আব্রাহাম দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে আরেকটা চেয়ার আনতে বলল।
চেয়ার এল।
জর্জ আব্রাহাম সান ওয়াকারকে বলর, ‘চেয়ারে উঠে বস।’
সান ওয়াকার ম্লান হাসল। বলল, ‘প্রশস্থ মেঝেতেই ভাল আছি স্যার। বলুন, আপনার প্রশ্নের জবাব দেব।’
‘ধন্যবাদ সান ওয়াকার, জবাব পেলে খুশী হবো। তুমি ভাল ছাত্র।তোমার বিরাট ভবিষ্যত আছে। তুমি যদি আমাদের সহযোগিতা বরো, তাহলে তোমার ব্যাপারটা আমরা নতুন করে ভেবে দেখবো।’ নরম কন্ঠে বলল জর্জ আব্রাহাম।
সান ওয়াকার জবাবে কিছু বলল না। শুধু তার ঠোঁটের কোণে একটা তীক্ত হাসি ক্ষনীকের জন্য ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল।
জর্জ আব্রাহামের হাতে একটা ফাইল। ফাইলের ভেতরটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, তোমার বিষয়ে আমরা এ ফাইলটা চুরি করেছি কিংবা বলতে পার, ম্যানেজ করে এনেছি এফবিআই-এর পলিটিক্যাল সেকশন থেকে এখানে তোমার সম্পর্কে এমন অনেক কতা আছে যা আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। রেড ইন্ডিয়ানরা নতুন করে সংগঠিত হওয়া এবং তাদের সাথে মুসলমান ও আফ্রিকান আমেরিকান সখ্যতা, ইত্যাদি বিষয়ে তোমার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকার কথা এখানে আছে। এসব বিষয়ে তোমার কাছে কিছু জানতে চাই।’
বলে একটু থামল জর্জ আব্রাহাম।
একটু ভাবল। যেন চিন্তাটা গুছিয়ে নিল সে। তারপর বলল, ‘আমেরিকায় ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট (AIM) কে জান?’
‘অবশ্যই।’
‘ধন্যবাদ। মুভমেন্টের সাথে তুমি শরিক আছ?’
‘সকল ইন্ডিয়ানই আছে। আমিও আছে।’
‘তোমার কি দায়িত্ব সেখানে?,
‘কর্মি মাত্র।’
‘গত মাসের কাহেকিয়া সম্মেলনে (AIM) এর দাবীনামা কে ড্রাফট করেছে?’
‘আমি।’
‘একজন কর্মি কি এই দায়িত্ব পায়?
‘হয়ত পায় না, কিন্তু আমাকে তারা এ দায়িত্ব দিয়েছিল।’
‘দাবীগুলোর মূল উদ্দেশ্য কি?’
‘রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া অধিকার ফিরে পাওয়া।’
‘মিথ্যে কথা।’
‘তাহলে সত্যিটা কি?’
‘আমেরিকান নেশনকে দু’ভাগ করে সংঘাত বাধানো।’
‘এটা একেবারেই বানানো কথা।’
‘কাহোকিয়ায় রেড ইন্ডিয়ানদের ১ লাক প্রতিনিধিদের যে সম্মেলন হলো, তাতে কত খরচ হয়েছে জান?’
‘জানি না।’
‘৫ কোটি ডলার। এবং সব টাকাই দিয়েছে আন্তর্জাতিক একটি মুসলিম সংস্থা।’
চমকে উঠল সান ওয়াকার। এ ধরনের কোন তথ্য তারা জানা নেই এবং সত্যও নয়। সান ওয়াকার জানে, সম্মেলনের খরচ সংকুলান হয়েছে ডেলিগেট ফি এবং চাঁদা আদায় থেকে। সকলের জানা বিষয়টি এরাও জানে অবশ্যই। কিন্তু এক অবিশ্বাস্য অভিযোগ তুলছে কেন? সন্দেহ নেই, রেড ইন্ডিয়ানদের বদনাম ও তাদের উপর কোন পদেক্ষেপকে জাস্টিফাই করার জন্যেই এই অভিযোগ। সান ওয়াকার দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘আপনি শেষ যে তথ্যটি দিলেন তা সত্য নয়।এবং এটা রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য খুবই অপমানজনক। আর কোন মুসলিম সংস্থা এমন অর্থ দেবেই না কেন?’
‘দেবে কেন? মুসলমানদের সাথে রেড ইন্ডিয়ানদের যে দহরম-মহরম তার মূল্যের ক্ষেত্রে ৫ কোটি টাকা কিছুই নয়।’
‘মুসলমানদের সাথে দহরম-মহরম? কোথায়?
‘মুসলমানদের সাথে তোমাদের বিয়ে-শাদী ও সামাজিক সম্পর্ক দারূণভাবে বেড়েছে। কাহোকিয়া সম্মেলনে ১ লাখ প্রতিনিধির মধ্যে প্রচুর মুসলিম ছিল।’
‘তারা মুসলিম হিসেবে আসেনি, এসেছিল রেড ইন্ডিয়ান হিসেবে। যেমন এসেছিল প্রচুর খৃষ্টান রেড ইন্ডিয়ান। আর বিয়ে-শাদীর ব্যাপারটা সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে হয়, বিশেষ কোন ধর্ম বিচার করে হয় না।’
আমি এই সামাজিক সম্পর্কের কথাই বলছি। মুসলমানদের সাথে সামাজিক ঘনিষ্ঠতা রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সাংঘাতিক ভাবে বেড়েছে।’
‘বেড়েছে একথা ঠিক নয়। ঐতিহাসিক কারণে ইউরোপীয়রা এদেশে আসার অনেক আগে থেকে মুসলমানদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক ছিল, সেই সম্পর্ক এখনও আছে। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারটা আগে হয়তো প্রচার হতো না। এখন হচ্ছে।’
‘কাহোকিয়া সম্মেলনে ইসলামী ইসলামী সম্মেলন সংস্থার প্রতিনিধি এসেছিল কেন?’
‘যে নীতির ভিত্তিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ভ্যাটিক্যান, ইত্যাদি বিশ্ব সংগঠনের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল, সে নীতির ভিত্তিতেই দাওয়াত দেয়া হয় ওআইসি’কে।
‘আসলে কাহোকিয়া সম্মেলন ছিল আমেরিকান নেশনকে ভাগ করার এক বিশ্বমহড়া।’
‘না এটা ঠিক নয়। মার্কিন সংবিধান তার মার্কিন নাগরিকদের যে অধিকার দিয়েছে তার এক ইঞ্চি বাইরে রেড ইন্ডিয়ানরা যায়নি।’
রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছে জর্জ আব্রাহামের। লাল ক্রুদ্ধ স্বরে, ‘এই রেড ইন্ডিয়ানের বাচ্চা, সব কথা সব আইন সংবিধানে লেখা থাকে না। বাস্তবতা কি? পরাজিত ও বিজয়ী কি এক আসন পাবে? একই অধিকার পাবে?’ থামল জর্জ আব্রাহাম।
কোন উত্তর দিল না সান ওয়াকার।
জর্জ আব্রাহামই আবার কথা বলল। বলল সে, ‘বুঝা গেছে আমার কথা? তোদের কাহোকিয়া সম্মেলন, দাবি-দাওয়া সবই অনধিকার চর্চা। মার্কিন সরকার সংবিধান দেখে তোদের চোখ দিয়ে। তোদের মত ওরাও শ্বেতাঙ্গ জাতির শত্রু। তোদের ধ্বংস করার পর ওদেরকেও আমরা শেষ করব। শত্রুরা কেউ বাঁচবে না আমাদের হাত থেকে।’ বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল জর্জ আব্রাহাম।
জর্জ আব্রাহাম থামলেও সান ওয়াকার চুপ করে থাকল। কি উত্তর দেবে এসব কথার? কোন যুক্তি দিয়ে হিংসার আগুন নেভানো যাবে না। জর্জ আব্রাহামের কথার মধ্য দিয়ে যে বর্ণবাদী দৈত্যের চেহারা নগ্ন হয়ে উঠল, তা দেখে সান ওয়াকার সত্যিই আrকে উঠেছে।
উত্তেজিত জর্জ আব্রাহাম চেয়ার থেকে উঠে পায়চারি করছিল। দু’টি হাত তার পেছনে মুষ্টিবদ্ধ।
এক সময় সান ওয়াকারের মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল শক্ত কন্ঠে, ‘তুমি মৃত্যু থেকে বাঁচতে পার তিনটি শর্তে। এক, কাহোকিয়া সম্মেলনে গোপন ভোটে তিনশ’ সদস্যের যে ‘রিজিওনাল কাউন্সিল’ গঠিত হয়েছে তার তালিকা আমরা চাই। দুই, মেরী রোজ-এর সাথে কোন সম্পর্ক রাখবেনা তার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এবং তিন, তোমাকে আমেরিকা ত্যাগ করতে হবে। এশিয়ায় যাওয়া এবং সেখানে থাকার ব্যবস্থা আমরা করে দেব। এখন তুমি বল, মৃত্যু এবং শর্তগুলোর কোনটা পছন্দনীয়।’
শর্তগুলো শুনে বিস্মিত হলো সান ওয়াকার। বিস্মিত হলো এই কারনে যে, তার মত একজন ছাত্রকে এত ভয় করে ওরা? আরও বিস্মিত হলো তাদের অসহনশীলতার ভয়াবহ রুপ দেখে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের শ্রেষ্ঠতম নিশান বরদার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ জীবনের অভ্যন্তরে এই ধরনের সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরাও বাস করছে? জর্জ আব্রাহামের জবাবে বলল সান ওয়াকার, ‘মৃত্যু জীবনে একবার আসবেই। মৃত্যু আমার কাছে ভয়ের বস্তু নয়। তবে মৃত্যুকে ভয় করলেও আপনাদের তিন শর্তে রাজী হতাম না।’
আগুন ঝরে পড়ল জর্জ আব্রাহামের চোখ থেকে। বলল, ‘তোরা সব শ্বেতাংগ বিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের এজেন্ট।’ বলে সে পাশে দাঁড়ানো গুন্ডামার্কা দু’জন লোকের একজনের দিকে চেয়ে বলল, ‘এর মুখটা একটু ঠিক করে দাও যাতে এই ধরনের বেয়াদবী আর না করে।’
জর্জ আব্রাহামের কথা শেষ হবার আগেই লোকটির ঘুষি গিয়ে পড়ল সান ওয়াকারের মুখে।
সান ওয়াকার ‘তেল ঢালা স্নিগ্ধ তনু তন্দ্রা রসে ভরা’ ধরনের ছেলে নয়। কিন্তু আঘাতটা এতটাই আকস্মিক হয়েছে যে, সতর্ক হবার বিন্দুমাত্র সুযোগও সে পায়নি।
লোকটির ঘুষি গিয়ে সান ওয়াকারের একেবারে মুখে আঘাত করেছিল। আহত ঠোট আবার ফেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল ঝরঝর করে।
পড়তে গিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল সান ওয়াকার।
সান ওয়াকারের রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে জর্জ আব্রাহাম ক্রুর হেসে বলল, ‘মরার আগে এ ধরনের আরও বহু ডোজ আসবে। শত্রুর আরামদায়ক মৃত্যু হোয়াইট ঈগলের অভিধানে নেই। এখন ভেবে দেখ মৃত্যু সহজ, না শর্তগুলো সহজ। মৃত্যু পর্যন্ত ভাববার সুযোগ দেয়া হলো। এরা প্রতিদিনই আসবে। প্রতিদিনই তোমার দেহের উপর কাজ চলবে মৃত্যুকে এগিয়ে আনার জন্যে।’
বলে চলে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল জর্জ আব্রাহাম।
জর্জের সাথে বেরিয়ে গেল গুন্ডা দু’জনও। কক্ষের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
সম্ভবত ভুল করে ওরা ঘর থেকে চেয়ার দু’টো বের করে নিয়ে যায়নি। সান ওয়াকার গিয়ে বসল চেয়ারে।
চেয়ারে গিয়ে বসতেই মনে পড়ল মেরী রোজ-এর কথা। তার কোন বিপদ হয়নি তো? পরক্ষণেই আবার ভাবল সে চীফ জাস্টিসের মেয়ে। তাকে অবশ্যই কেউ এমনভাবে ঘাঁটাবে না যা মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও প্রভাবশালী প্রধান বিচারপতিকে বিরক্ত করতে পারে। কি করছে মেরী রোজ? সে অবশ্যই জানতে পেরেছে সান ওয়াকারের ঘটনা। কিন্তু অবশ্যই জানতে পারেনি কারা তাকে কিডন্যাপ করেছে কোন কারণে। সান ওয়াকার নিশ্চিত এদের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করার কেউ নেই। রেড ইন্ডিয়ানরা বিষয়টা জানতেই পারবে না। পুলিশ কিছু করলে? কিন্তু পুলিশের উপর তার কোন আস্থা নেই। ওদের নিষ্ক্রিয় করতে হোয়াইট ঈগলের মত সংগঠনের বেগ পেতে হবে না। চারদিকে হতাশার অন্ধকারের মধ্যেও দু’টি বিষয় আনন্দের সূর্য হয়ে তার সামনে এল। একটি মেরী রোজ-এর প্রেম, আরেকটি রেড ইন্ডিয়ানদের জাগরণ যা খুনী বর্ণবাদীদের আতংকিত করেছে।
‘রেড ইন্ডিয়ানরা আমেরিকান জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করছে’- জর্জ আব্রাহামের এই কথা মনে হতেই বিদ্রূপের একটা হাসি ফুটে উঠল সান ওয়াকারের মুখে। মনে মনে সে বলল রেড ইন্ডিয়ানরা তোমাদের চেয়ে বেশি আমেরিকান। ছিনিয়ে নেয়া অধিকার ফিরিয়ে চাওয়া আমেরিকানদের বিভক্ত করা নয়। বরং এই অবিচারের অবসান হলে আমেরিকানরা আরও সংহত হবে।
ঠোঁটের ব্যথায় তার চিন্তায় ছেদ পড়ল।
জামার আস্তিন দিয়ে ঠোঁট মোছার জন্যে হাতটা উপরে তুলল সান ওয়াকার।
তাকাল সে চাদর ছাড়া শুধু ফোম বিছানো খাটিয়ার দিকে। শোয়ার এটুকু আয়োজনকেই তার কাছে অমৃত মনে হচ্ছে। ক্লান্ত, বেদনা কাতর দেহ জুড়ে নেমে আসছে অবসাদ। তার কাছে এখন ঘুমের চেয়ে মূল্যবান কিছু দুনিয়াতে আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে চেয়ার থেকে উঠে ধীরে ধীরে এগুলো খাটিয়ার দিকে।
কক্ষের দরজা খুলে যেতেই দু’জন স্টেনগানধারী দরজায় এসে দাঁড়াল।
তারপর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল মধ্যবয়সী সুবেশধারী ভারী চেহারার একজন লোক। তার সাথে একজন যুবক। তাদের পেছনে পেছনে প্রবেশ করল আরও দু’জন স্টেনগানধারী।
আহমদ মুসা বলেই বোধহয় নিরাপত্তার এই বাড়তি ব্যবস্থা।
আহমদ মুসা উঠে বসেছিল বিছানায়।
স্টেনগানধারী দু’জন খাটের দু’পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
সুবেশধারী মাঝ বয়সী লোকটি দৃঢ় পদক্ষেপে এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি ডেভিড গোল্ড ওয়াটার। আমি…..।’
ডেভিড গোল্ড ওয়াটারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, ‘হোয়াইট ঈগলের প্রধান।’
‘আপনি জানলেন কি করে?’
‘জানতে পেরেছি সানসালভাদর দ্বীপে থাকতেই।’
‘এখন আপনি কোথায়? সানসালভাদর দ্বীপে নেই এখন?’
‘আপনাকে এবং বন্দীখানা দেখে এখন মনে হচ্ছে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।’
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আপনাকে ধন্যবাদ। এই দ্বিতীয় ধন্যবাদটা কেন দিলাম জানেন?’
আহমদ মুসা কোন জবাব দিল না। গোল্ড ওয়াটার নিজেই কথা বলল আবার। বলল, ‘দ্বিতীয় ধন্যবাদ এই কারণে যে আপনি হোয়াইট ঈগল-এর বন্দীখানাকে ধন্য করেছেন। আজ ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান, সিনবেথ, ব্ল্যাক ক্রস, ফ্র, ইত্যাদি বিশ্ব বিখ্যাত সংগঠনগুলো আমাদের এ বন্দীখানার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।’
‘ওদের বন্দীখানাতেও ছিলাম।’
‘ছিলেন হয়তো, কিন্তু তখন এত সাড়া পড়েনি। এখন সবাই ছুটে আসছে এ বন্দীখানার দিকে।’
‘ওরা জানল কি করে?’
‘জানিয়েছি আমি ক্লু ক্ল্যাক্স ক্ল্যানের মি: বেনজামিলকে। উনিই জানিয়েছেন সবাইকে। এতে আমার ভালই হয়েছে।’
‘কি ভাল হয়েছে?’
হাসল ডেভিড গোল্ড ওয়াটার। বলল, ‘এতে দর কষাকষির সুবিধা হয়েছে।’
‘কিসের দর কষাকষি?’
আবার একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল গোল্ড ওয়াটারের ঠোঁটে। বলল, ‘আপনাকে কে কত দামে কিনতে পারে, সেইটা। ইতিমধ্যেই বেনজামিল ১ বিলিয়ন ডলার দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি মনে করছি, এর চেয়ে অনেক বেশী দাম আমি পাব। দেখা যাচ্ছে সবাই দারুণ আগ্রহী। সবচেয়ে আগ্রহী দেখা যাচ্ছে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা সিনবেথকে। আমি তার কাছে মূল্য চেয়েছি ৩ বিলিয়ন ডলার।’
‘ব্যবসায়ের সুন্দর সুযোগ পেয়েছেন।’
‘আপনার প্রতিক্রিয়া কি?’
‘আমার কোন সমস্যা নেই। সব বন্দীখানা বন্দীখানাই। শত্রুর মধ্যে বড় ছোট আছে, কিন্তু ভাল-মন্দ নেই।’
‘না ভাল-মন্দ আছে। দেখুন, আমরা আপনাকে মারছি না কিংবা মেরেও ফেলছি না। বিক্রি করছি মাত্র। আমাদের উদ্যোগটা নির্দোষই বলা যায়।’ বলল গোল্ড ওয়াটার মুখে ক্রুর হাসি টেনে।
বলেই একটু থামল। তারপর আবার শুরু করল, ‘সে যাক, ‘কাজের কথায় আসি। কখন বিক্রি হয়ে যান, ঠিক তো নেই, আমাদের কয়েকটা কথা জানা দরকার।’ বলে একটু থামল।
আহমদ মুসা কোন জবাব দিল না।
গোল্ড ওয়াটারই আবার বলল, ‘আপনি আমাদের দু’শরও বেশী লোক হত্যা করেছেন। কিন্তু এটা আমার কাছে কোন বড় বিষয় নয়?’
‘কেন?’
‘এই কারণে যে আহমদ মুসা প্রতিপক্ষ যেখানে, সেখানে দু’শো, তিনশ, লোক গায়েব হওয়া বা নিহত হওয়া বিস্ময়ের ছিল না। আমাদের কাছে বড় বিষয় হলো, আমাদের লোকগুলোকে কি করে গায়েব করলেন?’
‘না এটা বলবো না। শত্রুকে কৌশল জানানো যাবে না।’
‘একজন বন্দীর মুখে এই কথা মানায় না। জানেন আমরা কি করতে পারি?’
‘সব জেনেই বলছি।’
‘কতটুকু জানেন আপনি? বলুন তো এই মুহূর্তে আমি কি করতে পারি?’
‘আপনার হাতে ইলেকট্রনিক্যাল যে হ্যান্ড ডাইরী দেখছি, ওটা হ্যান্ড ডাইরী নয়। অত্যন্ত পাওয়ারফুল বিদ্যুত জেনারেটর ওটা। ডাইরী ওপেনের যে ‘কী’টা সামনে দেখা যাচ্ছে ওটায় চাপ দিলেই দু’পাশ থেকে দু’টো বৈদ্যুতিক তার বেরিয়ে আসবে। ঐ তারের মাথায় মানুষের চামড়া কামড়ে ধরার মত প্লাগ আছে। প্লাগ দু’টো কারো দেহে আটকে দিয়ে সুইট টিপলেই প্রবাহমান বিদ্যুতের যন্ত্রণাদায়ক অব্যাহত চাবুকে সে বাঁদর নাচ শুরু করে দেবে।’
বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেছে গোল্ড ওয়াটারের। কিছুক্ষণ সে কথা বলতেই যেন ভুলে গেল।
অনেকক্ষণ পর বিস্মিত কণ্ঠে সে বলল, ‘ইলেকট্রনিক্যাল যে ডাটা ডায়েরী আছে, তার সাথে এর সামান্য পার্থক্যও নেই। একে আপনি ডায়েরী না ভেবে অস্ত্র ভাবলেন কি করে?’
‘খুবই সোজা হিসাব। ঐ ধরনের কোন ডাটা ডায়েরী নিয়ে এই বন্দীখানায় আমার কাছে আপনার আসার কোন যৌক্তিকতা নেই। সুতরাং যেটা এনেছেন সেটা একজন বন্দীকে ভয় দেখাবার মত কোন জিনিসই হবে।’
গোল্ড ওয়াটারের চোখে-মুখে সপ্রশংস ভাব ফুটে উঠল। বলল সে পরক্ষণেই, ‘ধন্যবাদ, আরেকটা প্রশ্নের জবাব দিন। এই যন্ত্রটা মাত্র গতকাল বাজারে এসেছে এক আমেরিকান কোম্পানীর তরফ থেকে। সুতরাং এই যন্ত্রটা কোনভাবেই আপনি দেখেননি, জানেন না, কিন্তু ঐ নিখুঁত বিবরণ দিলেন কি করে?’
‘দেখিনি বটে, জানি না একথা টিক নয়। আজ থেকে ৬মাস আগে ‘ইনভেনশন’ ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যায় এই অস্ত্রের সাইজ এবং বিবরণ পড়েছিলাম।’
হাসল গোল্ড ওয়াটার। বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, সত্যি আপনি এক বিস্ময়কর শত্রু। আপনি যদি বন্ধু হতেন, তাহলে কতই না ভাল হতো!’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপনি আমার শত্রু কিন্তু আমি আপনার শত্রু নই। আপনি বা আপনারা মুসলমান বা অশ্বেতাংগদের উপর বৈরিতা ছাড়ুন, আপনারাও আমাদের বন্ধু হয়ে যাবেন।’
‘বন্ধুত্বের চেয়ে এখন আমাদের কাছে কাজ বড়। কাজের কথা বলুন।’
‘বলেছি, যে তথ্য মুসলমান ও কৃষ্ণাংগদের বিরুদ্ধে যাবে, সে তথ্য আপনারা আমার কাছ থেকে পাবেন না।’
‘সে দেখা যাবে। এখন বলুন, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ঐসব গোপন তথ্য FWTV টেলিভেশন নেটওয়ার্ক এবং WNA নিউজ এজেন্সীতে গেল কি করে?’
‘আমি পাঠিয়েছি।’
‘আপনি পাঠিয়েছেন?’ চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করল গোল্ড ওয়াটার।
প্রশ্ন করে মুহুর্তকাল থেমেই আবার প্রশ্ন করল, ‘আপনি পাঠালেই তা ওরা বিশ্বাস করবে কেন?’
‘অনেক সময় কে পাঠাল তা বড় বিষয় হয় না, কি পাঠানো হয়েছে তাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমাকে নয় আমার পাঠানো দলিলকে তারা বিশ্বাস করেছে।’
‘আহমদ মুসা আপনি যে অপরাধ করেছেন, কয়েকবার আপনাকে হত্যা করলেও তার শাস্তি সম্পূর্ণ হবে না। কিন্তু আমাদের ভাগ্য মন্দ।’
‘কেন?’
‘উপযুক্ত মূল্যে আমরা আপনাকে বিক্রি করছি। যারা টাকা দিয়ে কিনছে, তাদের এখন হক হয়ে গেছে আপনাকে বানানো তারা যেমন চায়।’
‘তাহলে আপনাদের জন্যে দুঃখেরই।’
‘লাভের তুলনাই তা কিছুই নয়। যে কয় বিলিয়ন ডলার আমরা পাচ্ছি আপনাকে বিক্রি করে, তা আমাদের আন্দোলনের চেহারা পাল্টে দেবে। সুতরাং আপনার প্রতি আমরা খুশীই বলতে পারেন।’
‘খুশী থাকার কোন চিহ্ন দেখছি না।’
‘কেন এত সুন্দর বন্দীখানা, এত সুন্দর বিছানা। আমাদের বন্দীখানার কোন কক্ষেই এ ব্যবস্থা নেই।’
বলে গোল্ড ওয়াটার হাতের ইলেকট্রনিক ডায়েরীটা পকেটে রেখে পকেট থেকে যা বের করল তা একটা ছোট্ট ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটরের মত জিনিস। তাতে বড় একটা স্ক্রিন এবং ছোট্ট একটা কী-বোর্ড।
সে একটা কী-বোর্ডে চাপ দিয়ে জিনিসটা আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল।
জিনিসটা একটা মিনি টেলিভিশন।
আহমদ মুসা টেলিভিশনটা হাতে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখল, বন্দীখানার কক্ষগুলো একের পর এক পর্দায় ভেসে উঠছে।
কক্ষগুলোর সবগুলোই একটি করে সংকীর্ণ সেল। লোহার খাটিয়ায় নগ্ন ফোম বিছানো। তার এক পাশে গোটানো খসখসে কম্বল।
একটা কক্ষে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল টেলিভিশনের ফোকাস।
আহমদ মুসার দৃষ্টি আছড়ে পড়ল আহত রক্তাক্ত একজন মানুষের উপর। শুয়ে আছে সে খাটিয়ার উপর। বন্দীটি একজন রেড ইন্ডিয়ান তরুণ।
‘কে এই বন্দীটি?’ জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
‘দেখেছেন তো কি অবস্থায় সে আছে, আর কি অবস্থায় আপনি আছেন?’
আহমদ মুসা তার কথার দিকে কান না দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কে এই বন্দি ছেলেটি?’
‘সে সান ওয়াকার। তার অনেক অপরাধ।’
‘চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাক, খুন ইত্যাদি নিশ্চয় নয়।’
‘তার চেয়েও বড় অপরাধ। সে ‘আমেরিকান ইন্ডিয়ানস মুভমেন্ট’ (AIM) – এর একেবারে ভেতরের লোক। গত মাসে কাহোকিয়াতে ইন্ডিয়ানদের যে সম্মেলন হয়েছে, সে সম্মেলনের যে সাংঘাতিক দাবীনামা তার ড্রাফট এই ছেলেটিই করেছে। আরও অপরাধ তার আছে। রেড ইন্ডিয়ানদের একটা গোপন রিজিওনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। সদস্যদের নাম তার কাছ থেকে আমরা চেয়েছিলাম, নামগুলো সে দিলে তাকে দেশ ত্যাগের একটা সুযোগ দিতাম, ছেলেটি খুব প্রতিভাবান শুধু এই বিবেচনায়।’
‘কেমন প্রতিভাবান?’
‘সে স্টুডেন্ট নোবল প্রাইজ পেয়েছে বিজ্ঞানে, এ বছর।’
‘এমন একটা প্রতিভাকে এভাবে বন্দী করে রেখেছেন?’
‘আমরা তো একজন বিজ্ঞানী ছাত্রকে বন্দী করে রাখিনি, আমরা বন্দী করে রেখেছি শয়তান রেড ইন্ডিয়ানদের এক শয়তান বাচ্চাকে। তাছাড়া সে বাইরে থাকলে সে একটা শ্বেতাংগ বিজ্ঞান প্রতিভাকে নষ্ট করত।’
‘কেমন?’
‘এরই ক্লাসমেট মেরী রোজ। সে স্টুডেন্ট নোবল প্রাইজ পায়নি বটে, কিন্তু উদীয়মান একটা বিজ্ঞান প্রতিভা। এ পর্যন্ত সে সকল পরীক্ষায় প্রথম হয়ে এসেছে। তার সাথে এ সম্প্রতি ফষ্টিনষ্টি শুরু করেছে।’
‘আপনারা ছেলেটিকে মেরে ফেলবেন?’
‘আমাদের শর্ত মানতে সে অস্বীকার করেছে, সুতরাং মৃত্যু তার অবধারিত।’
‘একটা বিরল বিজ্ঞান প্রতিভাকে আপনারা এভাবে ধ্বংস করবেন?’
‘ও রেড ইন্ডিয়ানদের বিজ্ঞান প্রতিভা, আমাদের নয়। তার প্রতিভা আমাদের বিরুদ্ধে যেতে শুরু করেছে, সে ভবিষ্যতে একজন প্রতিভাবান শত্রু হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং শুরুতেই শেষ হলে আমাদের সবার ভাল।’
‘কিন্তু আপনাদের এই কথা তো মার্কিন সরকার ও মার্কিন জনগণের নয়।’
‘হোয়াইট ঈগলই মার্কিন সরকার এবং মার্কিন জনগণ। এর বাইরে কিছুই নেই।’
‘কিন্তু এসব কথা একদিন প্রকাশ হবেই।’
‘হোয়াইট ঈগল-এর হোয়াইট আমেরিকা কাউকেই তোয়াক্কা করে না।’
‘মার্কিন জনগণকেও তোয়াক্কা করেন না?’
‘মার্কিন জনগণ আমাদের সাথে আছে।’
‘তাহলে আপনাদের আন্দোলনে এত রাখ-ঢাক কেন? গোপন কেন?’
‘গোপন অন্য কারণে। বাইরের প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে আমরা লক্ষ্যে পৌছুতে চাই।’
কথা শেষ করেই গোল্ড ওয়াটার বলে উঠল, ‘এত কথা দিয়ে আপনার কাজ কি?’
বলে একটু থামল। শুরু করল আবার, ‘ভদ্রভাবে যে বিষয় দু’টো জানতে চাইলাম। ভেবে দেখবেন। আবার আসব। আর এদের সাথে ব্যবসাটা আমাদের না হলে আমাদের অন্যভাবেও আসতে হতে পারে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসার হাত থেকে পকেট টিভি ছো মেরে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। মনে মনেই বলল, ‘ধন্যবাদ টিভি যন্ত্রটি হাতে দেবার জন্যে।’
টিভি যন্ত্রটি ছিল বন্দীখানাসহ গোটা অফিস বিল্ডিং-এর সর্ট সার্কিট টিভির মনিটর।
টিভি মনিটরিং ‘কী’ প্যানেলের প্রত্যেকটি ‘কী’-এর কোনটি ‘প্রিজন রুমস’, কোনটি ‘অফিস রুমস’, কোনটি ‘করিডোরস’, কোনটি ‘এক্সিটস’ বা বের হবার পথ, ইত্যাদির নির্দেশক।
আহমদ মুসা গোল্ড ওয়াটারের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে প্যানেলের ‘কী’গুলোর টিপে প্রয়োজনীয় জায়গাগুলো দেখে নিচ্ছিল। সে প্রথমেই দেখেছে করিডোর, তারপর বের হবার পথ। বের হবার পথ দেখল সে দুটি। একটা সামনের গেট। আরেকটা পথ পেছনে বন্দীখানার একটা করিডোর থেকে সুড়ঙ্গ সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেছে। কিন্তু সিঁড়ি মুখ বন্ধ। সিঁড়ি মুখের বাইরের দিকটাও দেখা গেল। সেটা এক তলার ছাদ।
সবশেষে আহমদ মুসা দেখছিল অফিস রুমগুলো। এই সময়ই টিভি মনিটরটি আহমদ মুসার হাত থেকে ছো মেরে নিয়ে নিল। গোল্ড ওয়াটার বেরিয়ে যাবার পর প্রহরীরা বেরিয়ে যেতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আহমদ মুসা লক্ষ্য করল দরজা ভেতর থেকে খোলার কোন ব্যবস্থা নেই।
এই হতাশার মধ্যেও আহমদ মুসা আনন্দিত হলো হোয়াইট ঈগলের এই ঘাটি সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করে।
ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন এন্ড লিগ্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট ব্যুরো (CI & LAB) এর সুসজ্জিত ড্রইং রুমে বসে আছে মেরী রোজ এবং শিলা সুসান। তারা অপেক্ষা করছে তাদের ডাক পড়ার।
‘CI & LAB’ আমেরিকার একটা বিখ্যাত ডিটেকটিভ ফার্ম।
ওয়াশিংটনেই তাদের হেড কোয়ার্টার।
শিলা সুসান ও মেরী রোজ সান ওয়াকার নিখোঁজ হওয়ার বিষয় নিয়ে টেলিফোনে এই ফার্মের সাথে আলাপ করে। সিআই এন্ড ল্যাব তাদেরকে জানায় সমস্যাটা লিখে জানাবার জন্যে, অবশ্য সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট কারও নামধাম উল্লেখ না করে এবং বলে তারা কেসটিকে যদি গ্রহণযোগ্য মনে করে তাহলে সাক্ষাr আলোচনার জন্যে ডাকবে। সেই ডাক পাওয়ার পরেই শিলা সুসান ও মেরী রোজ সিআই এন্ড ল্যাব এর অফিসে এসেছে।
বেশীক্ষণ বসে থাকতে হল না মেরী রোজদের। তাদের ডাক পড়ল।
তাদের সাক্ষাrকার দিচ্ছেন রন হাওয়ার্ড। সিআই এন্ড ল্যাব এর চীফ ডিটেকটিভ।
মেরী রোজ এবং শিলা সুসান প্রবেশ করল ঘরে।
একটা মাঝারী টেবিলে বসে আছেন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক।
স্লিম স্পোটিং চেহেরা।
একটা ফাইল পড়ছিল সে।
মেরী রোজরা ঘরে ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে স্বাগত জানাল মেরী রোজদের। মেরী রোজদের উপর নজর পড়তেই হঠাr তার মুখে বিস্ময়ের একটা ছায়া নেমে মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল।
টেবিলের সামনে পাশাপাশি দুটি চেয়ারে বসল মেরী রোজ ও শিলা সুসান।
তার আগে মেরী রোজ নিজের এবং শিলা সুসান এর পরিচয় দিল।
আমরা কথা শুরু করতে পারি এখন তাহলে? বলল রন হাওয়ার্ড স্মিত হাস্যে নরম কণ্ঠে।
অবশ্যই স্যার। বলল মেরী রোজ।
যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আপনাদের সমস্যা, সেটা অবশ্যই ইন্টারেস্টিং। এ ঘটনা আমরা সংবাদপত্রেও পড়েছি। পুলিশও কনফার্ম করেছে। আরও কিছু জানিয়েছিও আমরা। আমাদের জানার সাথে আপনাদের জানাটা মিলিয়ে নেবার জন্যেই আজ আপনাদের ডেকেছি। রন হাওয়ার্ড বলল। কেন আমাদের কেসটা গ্রহনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেননি। বলল শিলা সুসান।
ঈষr হাসল রন হাওয়ার্ড। বলল, ‘আমাদের জানাটা মিলিয়ে নেবার পর এ সিদ্ধান্ত আমরা নিব।
বলুন কি জানতে চান? বলল, মেরী রোজ।
আপনারা সমস্যার যে বিবরণ লিখে পাঠিয়েছেন, তাতে পরিস্কার যে, অপহরণকারীদের আপনারা জানেন? তারা কারা সেটা জানতে চাই।
অপহরণকারীদের আমরা জানিনা, কিন্তু তারা যে দলের লোক সে দলকে আমরা চিনি। বলল, মেরী রোজ।
সে দল কি হোয়াইট ঈগল?
আপনি কি করে জানলেন? বিস্মিত কণ্ঠে বলল শিলা সুসান।
পুলিশ সুত্রে জেনেছি। তাহলে এটা ঠিক?
ঠিক? বলল আবার শিলা সুসান। মুখটা ম্লান হল রন হাওয়ার্ডের।
ভাবল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলল, দুঃখিত মিস মেরী রোজ, শিলা সুসান, কেসটা গ্রহণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
এবার ম্লান হলো মিস মেরী রোজ, শিলা সুসানের মুখ। তারা এ ধরনের উত্তর আসা করেনি। অপ্রস্তুত অবস্থায় তারা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।
কেন? প্রশ্ন করল মেরী রোজ কয়েক মুহূর্ত পর।
আমাদের এটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। আমরা ব্যাক্তি ক্রাইম কিংবা গ্যাং ক্রাইম নিয়ে কাজ করি। এটা সে রকম নয়।
‘কেন এটা গ্যাং ক্রাইমের মধ্যে পড়ে।’বলল শিলা সুসান।
হাসল রন হাওয়ার্ড। বলল, তারা এক অর্থে গ্যাং হতে পারে, কিন্তু ক্রিমিনাল গ্যাং নয়, পলিটিকাল গ্যাং। এ ধরনের পলিটিকাল গ্যাং আমাদের আওতার বাইরে। এদের ব্যাপারে শুধু সরকারই কিছু করতে পারে।
কিন্তু সরকার তো কিছুই করছে না। বলল, মেরী রোজ।
সরকার কিছু করছে না নয়, পুলিশ কিছু করছে না।
তাহলে উপায়? আপনারাও কিছু করবেন না। তাহলে ঐ ক্রিমিনালরা তো মাথায় উঠে বসবে। বলল মেরী রোজ।
হাসল আবার রন হাওয়ার্ড। বলল, আপনার আব্বাকে বলুন। তিনি বললে কাজ হবে।
বিস্মিত হলো মেরী রোজ এবং শিলা সুসান দু’জনেই। বলল মেরী রোজ, ‘আপনি আমাকে চেনেন?
‘চিনি না। আপনাকে দেখে আপনার পরিচয় আমি পেয়েছি।একটা অনুষ্ঠানে আপনার আব্বার সাথে আপনাকে দেখেছিলাম।’
‘ধন্যবাদ।’
বলে একটু থেমে মেরী রোজ বলল, ‘আব্বাকে বলতাম। কিন্তু জানি, বললে তিনি এসব থেকে আমাকে দূরে থাকতে বলবেন। এবং বলবেন, পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দাও।’
‘তাহলে আমাদের হতাশা নিয়ে উঠতে হবে?’ বলল শিলা সুসান।
‘শুধু আমরাই নই কোন প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফার্মই এ ধরনের রাজনৈতিক কেস হাতে নেয় না।’
রাজনৈতিক ক্রাইম কি কোন ক্রাইম নয়? বলল মেরী রোজ?
‘ক্রাইম অবশ্যই। কিন্তু এ ক্রাইমের মোকাবেলা শুধু সরকারই করতে পারে।’
‘কিন্তু সরকার অর্থ পুলিশ এবং গোয়েন্দা সার্ভিসের লোক। তারাও রাজনৈতিক স্বীকার।’ বলল শিলা সুসান।
‘এই দুর্ভাগ্যের প্রতিকার নেই?’ বলল মেরী রোজ।
‘আছে। কিন্তু এজন্যে আব্রাহাম লিংকনের মত সাহসী কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। দেখুন, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে হোয়াইট ঈগলের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবার পর সেখানে প্রতিকার এসেছে।
নিশ্চয় সাহসী কেউ এগিয়ে এসেছিল, যার ফলে প্রতিকারের একটা পথ হয়েছে।’
‘আমার বাড়ি বাহামায়। আমি শুনেছি, একজন বিদেশী এসে এটা করেছে।’
‘একজন বিদেশী করেছে?’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল রন হাওয়ার্ড।
‘হ্যাঁ, একজন বিদেশী।’
‘কে সে? ইংল্যান্ড বা ইউরোপের মানবাধিকার আন্দোলনের কেউ?’
একটু দ্বিধা করল। তাকাল মেরী রোজে এর দিকে। তারপর বলল সুসান, ‘না ইউরোপের কেউ নয়। কে এক আহমদ মুসা নাকি এসব করেছে।’
চমকে উঠল রন হাওয়ার্ড নাম শুনার সাথে সাথে। চোখ কপালে তুলে বলল, ‘আহমদ মুসা ওখানে এসেছিল?’
‘আপনি চেনেন আহমদ মুসাকে?’ বলল শিলা সুসান।
‘দুনিয়ার খজ-খবর রাখে, অথচ তাকে জানে না এমন কেউ নেই।বিশেষত আমরা আমাদের সর্বোচ্চ মডেল হিসাবে তাঁকে শ্রদ্ধা করি।বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির পর্বতপ্রমাণ সংকটের সমাধান তিনি করে চলেছেন, তা আমাদের জন্যে শিক্ষার বিষয়।’
শিলা সুসান চিন্তা করছিল। তার কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠছে। সে ভাবছে, হোয়াইট ঈগলের হাতে আহমদ মুসার বন্দি হবার খবর মিঃ রন হাওয়ার্ডকে জানানো ঠিক হবে কিনা। অবশেষে সে ভাবল, আহমদ মুসাকে মুক্ত করার ব্যাপারে সে তো কিছুই করতে পারছে না। মিঃ রণকে বললে যদি কিছু সাহায্য হয়, বা পরামর্শ পাওয়া যায়।
এসব চিন্তা করে শিলা সুসান বলল, ‘আরেকটা খবর আমি সানসালভাদরেই শুনে এসেছি। আহমদ মুসা নাকি বন্দি হয়েছে হোয়াইট ঈগলের হাতে।’
শিলা সুসানের কথা কানে যাওয়ার সাথে সাথে তড়িতহতের মত মিঃ রন হাওয়ার্ড এর দেহ চেয়ারের উপর সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘একি ঠিক বলছেন আপনি?’
বিশ্বাসযোগ্য খবর না হলে আপনাকে বলতাম না। বলল শিলা সুসান।
অবশ্যই’ বলে হঠাr চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুজল রন হাওয়ার্ড।
মুহূর্ত পরেই চোখ খুলে সোজা হয়ে চেয়ারে বসল। বলল, ‘মিস মেরী রোজ আপনার সমস্যা সমাধানের একটা পথ সম্ভবত খুলে যাচ্ছে।’
-কি সেটা? মেরী রোজ বলল।
‘আহমদ মুসা যখন হোয়াইট ঈগলের হাতে, তখন দু’টি ঘটনার একটা অবশ্যই ঘটবে। হয় তারা আহমদ মুসাকে হত্যা করবে, নয়তো আহমদ মুসা নিজেকে মুক্ত করবে। আহমদ মুসা অবশেষে হোয়াইট ঈগলের বন্দিখানায় এসে মারা পড়বে, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়। মারা পরতেও পারে। কিন্তু সে যদি বেরুতে পারে, তাহলে সান ওয়াকার শুধু মুক্ত হওয়া নয়, আমেরিকায় কিছু বড় ঘটনা ঘটবে। আহমদ মুসা কোন দেশে পা দেয়ার অর্থই সেখানে বড় ধরনের কিছু ঘটবে।’
‘আহমদ মুসা সম্পর্কে আমি কিছু জানিনা। কিন্তু ঈশ্বরের কাছে পার্থনা করছি, আপানর শেষ কথাটা সত্যি হোক।’
আমিও চাই। বলল শিলা সুসান।
চাই আমিও। রন হাওয়ার্ড বলল গম্ভীর মুখে।
তাহলে আমরা উঠি? বলল মেরী রোজ।
উঠে দাঁড়াল মেরী রোজ ও শিলা সুসান।
রন হাওয়ার্ডও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি দুঃখিত যে, আপনাদের সাহায্যে আসতে পারলাম না।
তবে একটা কথা বলতে পারি, আজকের পর থেকে হোয়াইট ঈগলের গতি-বিধির উপর চোখ রাখতে চেষ্টা করব। আহমদ মুসার সাথে আমার সাক্ষাr আমার জন্যে মহা সৌভাগ্যের হবে।
‘ধন্যবাদ। তাঁর সাথে সান ওয়াকারের নামটাও আপনি ভুলবেন না’
‘নাম মনে থাকবে। কিন্তু আমার আলগা চোখ রাখায় কারও কোনও লাভ হবে কিনা জানিনা।’
আলগা কেন বলছেন? বলল শিলা সুসান।
কারণ, হোয়াইট ঈগলের সাথে কোন ভাবেই কোন সংঘাতে আমরা যাব না। আলগা মানে দূর থেকে চোখ রাখা।
তবু তো এটা এক পা অগ্রসর হওয়া। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বলল মেরী রোজ ও শিলা সুসান।
বেরিয়ে এল অফিস থেকে।
গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে পাশের সিটে মেরী রজ-এর দিকে চেয়ে সুসান বলল, এখন বুঝে দেখ, দেশের একটা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাইভেট গোয়েন্দা ফার্ম যদি হোয়াইট ঈগল এর ব্যাপারে এতটা নিষ্ক্রিয় হয়, তাহলে কার উপর ভরসা করা যাবে।
আহমদ মুসা সম্পর্কে উনি যা বললেন, এ ব্যাপারে তোর কি মত? বলল মেরী রোজ।
‘উনি সত্যি বলেছেন।’
‘কিন্তু হতাশা ছাড়া আর কিছুই দেখছিনা। মেরী রোজের একথাগুলো কান্নার মত করুণ শোনাল।’
হাল ছেড়ে দেয়ার মত গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে মেরী রোজ।
শিলা সুসান একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘হোয়াইট ঈগলের হেড কোয়ার্টারের ঠিকানা তো পেয়েছিল। চল না কাল ওদিকে একটু যাই।’
‘কিন্তু তুই গোল্ড ওয়াটারের নজরে পড়লে তোকে সন্দেহ করতে পারে বলে ভয় করছিলি, তার কি হবে?’
‘তবু ভাবছি যাওয়া দরকার ওদিকে। আমার ধারনা হেড কোয়ার্টারেই ওরা বন্দি আছে। দেখলে বুঝা যাবে, কিছু করার আছে কিনা। তাছাড়া ভাবছি, গোল্ড ওয়াটারের নজরে পড়ে হেড কোয়ার্টারে প্রবেশের কোন সুযোগ পেলে টা মন্দ হবে না।’
‘ঠিক আছে কালকে তাহলে বেরুনো যাক।’
‘তাহলে এটাই কথা হলো, কাল ঠিক বেলা দশটায় দু’জনে দু’জার গাড়ি নিয়ে এক সাথে বেরুবো।’
‘দুই গাড়ি কেন?’
‘এসব অভিযানে দু’জন এক সাথে কোন বিপদে না পড়া উচিত। গোল্ড ওয়াটার দেখতে পেলে আমাকেই দেখুক, তোকে না। তুই তো সান ওয়াকারের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছিস।’
মুখটা প্রসন্ন হলো মেরী রোজ-এর। বলল, বুঝেছি। তোর দেখছি বুদ্ধি আছে।
‘একে বুদ্ধি বলে নাকি! এতো সামান্য কমনসেন্স। বুদ্ধি দেখতে হলে আহমদ মুসাকে দেখতে হবে।’
‘তুই দেখছিস নাকি তাঁকে?’ কৌতূহলী কণ্ঠে বলল মেরী রোজ। ‘দেখেছি বললে অনেক প্রশ্ন করবি। তাই থাক এসব কথা এখন।’ মেরী রোজের চোখে মুখে তখন বিস্ময়। বলল, ‘কি পুরু তোর বুক। এসব কথা লুকিয়ে রেখেছিস। কোন কথা নয় সব কথা এখনই বলতে হবে।’
বলে মেরী রোজ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল শিলা সুসানকে।
শিলা সুসান হাসল। বলল, ‘ছাড়, গাড়ি চালাতে দে বলছি।’
২
দরজার বাইরে কথা শুনতে পেল আহমদ মুসা। কথা বলছে গোল্ড ওয়াটার। বলছে, ‘মিঃ আইজ্যাক শ্যারণ সেদিনের কথা ভেবে আজ আপনার কেমন লাগছে বলুন তো?’
‘কি বলল। সেদিন চোখের সামনে তেলআবিবের পতন শুধু নয়, নিজেকে বাঁচাবার জন্যে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিলাম তেলআবিব থেকে।
সে বেদনার ক্ষতটা আজ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে।’
‘মিঃ আইজ্যাক শ্যারণ!’ আহমদ মুসা ভাবল, এ নিশ্চয় সেই জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ? তেলআবিবে সাইমুমের অভ্যুত্থানকালে এ ছিল ইসরাইলী গোয়েব্দা বাহিনীর সহকারী প্রধান। অন্যান্যদের সাথে গোয়েন্দা বাহিনীর চীফও সেদিন মারা যায়। সহকারী চীফ জেনারেল শ্যারণ সেদিন পালিয়ে বাঁচে। পালিয়ে বাঁচা এই আইজ্যাক শ্যারণই আজ আন্তর্জাতিক ইহুদী গোয়েন্দা চক্রের প্রধান। দ্রুত চিন্তা ঘুর পাক খাচ্ছে আহমদ মুসার মাথায়।
এসব ভাবতে ভাবতে আহমদ মুসার মনে প্রশ্ন জাগল, জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ আজ এখানে কেন? তাহলে কি তাঁকে বিক্রির ব্যাপারটা একদম চূড়ান্ত হয়ে গেছে এবং আজ তাঁকে দেলিভারি নিতে এসেছে।
কথাটা মনে হবার সাথে সাথেই আহমদ মুসার গোটা দেহে একটা বিদ্যুr চমক খেলে গেল।
মন বলে উঠল মানুষ কেনা-বেচার এই ব্যাবসাকে সফল হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু কিভাবে? নিশ্চয় ওরা আট-ঘাট বেঁধেই আসছে।
এর আগে দু’বার স্থানান্তরের সময় সংজ্ঞাহীন করেছিল।
এবার তারা কি করবে?
আহমার মুসা ভাবল, তার সম্পর্কে গোল্ড ওয়াটার ও তার লোকদের মাঝে যে সুধারনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা তার জন্যে একটা পুঁজি।
এখানে বন্দী থাকার দিনগুলোতে আহমদ মুসা একজন অনুগত গোবেচারা বন্দীর ভূমিকা পালন করেছে। তার আচরণ দেখে গোল্ড ওয়াটার একদিন বলেছে, ‘আপনার সম্পর্কে যা শুনেছি, তার কিছুই তো আপনার মধ্যে দেখছি না।’
আহমদ মুসা বলেছে, ‘কি শুনেছিলেন? ভয়ানক ক্রিমিনাল চরিত্রের?’
‘না। শুনেছি আপনি বাঘের মত ক্ষীপ্র, সিংহের মত সাহসি এবং শৃগালের মত ধূর্ত।’
আহমদ মুসা হেসেছে। বলেছে, ‘ওদের তেজ বনে। আমার মত খাঁচায় বন্দি হবার পরও ওরা আমার মতই গো’ বেচারা।’
এইভাবে আহমদ মুসা সম্পর্কে ওদের একটা ধরনা হয়েছে যে, সে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে। সম্ভবত এই কারনেই আহমদ মুসার উপর ওদের পাহারাদারী অনেক শিথিল। আহমদ মুসা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল ওদের ঢিলেঢালা ভাব অন্যান্যা দিনের মত আজও যেন থাকে।
আহমদ মুসা শুয়েছিল। শুয়েই থাকল। দরজা খুলে গেল।
দরজা খুলে যাবার পর দরজায় এসে দাঁড়াল দু’জন প্রহরী। তাদের হাতে স্টেনগান। স্টেনগানের ব্যারেল নিম্নমুখী।
তারপর প্রথমেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করল গোল্ড ওয়াটার। তার পেছনে পেছেনে লাল তামাটে রঙের দীর্ঘকায় একজন লোক। আহমদ মুসা বুঝল এই লোকটিই গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ।
তাদের পেছনে একটা কফিন ধরাধরি করে নিয়ে এল আরও দু’জন লোক। তাদের কাঁধে স্টেনগান ঝুলানো। সে লোক দু’টি লাল তামাটে রঙের। এরা ইহুদী জেনারেলের সাথে এসেছে।
আহমদ মুসা বুঝল, আগের মতই সংজ্ঞাহীন করে এই কফিনে পুরে তাঁকে পাচার করা হবে ইহুদীদের হাতে।
ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে উঠল আহমদ মুসা শোয়া থেকে। ঠিক দরজা মুখোমুখি হয়ে পা ঝুলিয়ে বসল খাটিয়ায়।
কফিনটি এনে রাখল ঠিক মাঝখানে। বহনকারী লোক দুজন তার পাঁশেই দাঁড়াল।
ঘরে ঢুকেই জেনারেল জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
জেনারেল আইজ্যাক শ্যারনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ‘জেনারেল, মনে হচ্ছে তুমি শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দরকার নেই। শিকার হাতের মুঠোয়। আর কিছুক্ষণ পর চলে যাবে তোমাদের খাঁচায়।’
‘ধন্যাবাদ গোল্ড ওয়াটার, শয়তানের বাচ্চাকে অবশেষে হাতে পাওয়া গেল। মাথায় আমাদের বাড়ি দিয়েছে এই শয়তান।’
‘ঠিক আছে। এর মাথায় বাড়ি দিয়ে তার শোধ তুলে নিবেন।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘এর এক মাথা ভেঙ্গে লাভ কি। ভাঙতে হবে ওদের গোষ্ঠী শুদ্ধ মাথা। সে সুযোগ এখন হাতের মুঠোয়।‘
‘কিভাবে?’
‘এই শয়তানের বাচ্চাকে দেখিয়ে সব শয়তানের বাচ্চাকে খোঁয়াড়ে তুলব। তারপর শুধু ওদের মাথা নয়, ওদের দেশ ভাঙ্গারও সুযোগ আসবে।’
‘এ ধরনের স্বপ্ন আপনার কতবার ভংগ হয়েছে জেনারেল?’
বলল আহমদ মুসা খুব শান্ত কণ্ঠে।
জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ পায়চারী করছিল আর কথা বলছিল। সে আহমদ মুসার সামনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াল। তার অগ্নি দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ব। পকেট থেকে সে বের করল রিভালবার। বলল, ‘শয়তানের বাচ্চা সে সব স্বপ্ন ভঙ্গের জন্যে তুই দায়ী।’
বলে সে রিভারবারের বাঁট দিয়ে আহমদ মুসার মাথায় আঘাত করতে গিয়েও থেমে গেল। তাকাল সে স্টেনগান কাঁধে ঝুলানো কফিনের কাছে দাঁড়ানো লোক দুজনের দিকে। বলল, ‘আর দেরী নয়, তোমাদের কাজ শুরু কর। শয়তানের বাচ্চাকে দেখব আমাদের কব্জায় নিয়ে গিয়ে।’
জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ বলার সাথে সাথে দু’জনের একজন কোটের পকেট থেকে ছোট বাঁট ও লম্বা ব্যারেল ওয়ালা স্প্রে গানের মত একটা জিনিস বের করল। দেখেই আহমদ মুসা বুঝল, ওটা স্প্রে গান নয়, কারণ স্প্রে গান হলে সবাই তার কবলে পড়বে।
নিশ্চয় ওটা এ্যানেসথেসিয়া গান। যার বুলেট শুধু চামড়া ভেদ করে এবং বুলেটের এ্যানেসথেসিয়া বিষ সঙ্গে সঙ্গেই মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। একজন ইহুদী অতি সম্প্রতি এটা আবিস্কার করেছে।
লোকটি এ্যানেসথেসিয়া গান হাতে নিয়েই তাক করল আহমদ মুসাকে।
জেনারেল শ্যারণ তখনও তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে। তার হাতে রিভারবাল। বাঁট দিয়ে আহমদ মুসাকে আঘাত করার জন্যে যেভাবে সে রিভারবাল ধরেছিল, সেভাবেই ধরে আছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আহমদ মুসা। এ্যানেসথেসিয়া বুলেট তাঁকে আঘাত হানার পর তার আর কোন সুযোগ থাকবে না।
আহমদ মুসা বসা অবস্থা থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ-এর উপর।
বাঁট ধরে কেড়ে নিল তার হাত থেকে রিভারবাল। সেই সাথেই তার পেছনে গিয়ে বাম হাত দিয়ে সাঁড়াশির মত পেছিয়ে ধরল তার গলা। ডান হাতের রিভারবাল চেপে ধরল তার মাথায়। এবং চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, ‘যার কাছে যে রিভারবাল আছে, দরজার দিকে ফেলে দাও। মুহূর্ত দেরী করলে গুড়ো হয়ে যাবে জেনারেল শ্যারণের মাথা।’
বলে আহমদ মুসা জেনারেল শ্যারণকে টেনে পশ্চিম দেয়ালের দিকে সরে গেল।
আহমদ মুসা নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে কফিনের পাঁশে দাঁড়ানো লোক দু’জন তাদের কাঁধের স্টেনগান ছুরে দিয়েছে দরজার দিকে।
গোল্ড ওয়াটারের চোখ দু’টি ছানাবড়া। হতবুদ্ধি তার চেহারা। সেও ধীরে ধীরে তার রিভারবাল ছুড়ে দিল দরজার দিকে।
দরজায় দাঁড়ানো দু’জন স্টেনগানধারী তাদের স্টেনগান তখনও ফেলেনি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে তারা দাঁড়িয়ে।
গোল্ড ওয়াটার ওদেরকে স্টেনগান ফেলে দিয়ে ভিতরে ঢুকতে বল। অনুচ্চ, কিন্তু কঠোর কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
গোল্ড ওয়াটার ওদেরকে নির্দেশ দিল।
ওরা হাতের স্টেনগান করিডোরের উপর ফেলে দিয়ে একপা দু’পা করে ঘরে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা জেনারেল শ্যারণকে সামনে রেখে তাঁকে টেনে নিয়ে পিছু হেঁটে দরজার বাইরে চলে এল।আসার সময় দরজার উপর ছড়িয়ে থাকা স্টেনগান ও রিভারবাল পা দিয়ে টেনে নিল দরজার বাইরে।
দরজার বাইরে এসে আহমদ মুসা বাম হাত সরিয়ে নিল জেনারেল শ্যারণের গলা থেকে। কিন্তু তার হাতের রিভারবাল জেনারেল শ্যারণের মাথা স্পর্শ করে থাকল স্থির ভাবে। বলল সে, ‘ তোমরা কেউ সামান্য নড়াচড়া করলে ছাতু হয়ে যাবে জেনারেল শ্যারণের মাথা।
বলে আহমদ মুসা ডোর লকের কী বোর্ডের দিকে তাকাল। দেখল অটো লক সিস্টেম। বন্ধ করার জন্যে একটা লাল বোতাম চাপতে হয় মাত্র।
আহমদ মুসা বাম হাতে লাল বোতাম চেপে ধরে ডান হাত ও হাটু দিয়ে ধাক্কা মেরে জেনারেল শ্যারণ কে ঢুকিয়ে দিল ঘরে। সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
দরজা বন্ধ হবার প্রায় সংগে সংগেই আহমদ মুসার কানে এল চারদিক থেকে এ্যালারমের শব্দ।
সচকিত হয়ে উঠল আহমদ মুসা। বুঝল, ঘরে বন্ধ গোল্ড ওয়াটার রিমোর্ট-এর মাধ্যমে এ্যালার্ম বাজিয়ে দিয়েছে। তার মানে এখন যে যেখানে আছে সেখান থেকে ছুটে আসবে। নিশ্চয় সে এই কৌশলে সবাইকে নির্দেশও দিতে পারবে কি ঘটেছে এবং কি করতে হবে।
তাহলে ওদের ঘরে বন্দী করে লাভ খুব একটা হলো না- এই কথা ভাবতে ভাবতে আহমদ মুসা চারদিকে তাকিয়ে সর্ট সার্কিট টিভি স্ক্রীনে দেখে পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল।
ছুটল সে করিডোর ধরে পশ্চিম দিকে।
একটা দরজার পাশ দিয়ে যাবার সময় আহমদ মুসা পুরুষ কণ্ঠের আর্ত চিৎকার শুনতে পেল। হঠাৎ তার মনে পড়ল গোল্ড ওয়াটারের সর্ট সার্কিট টিভি স্ক্রীনে দেখা এবং তার কাছ থেকে শোনা সান ওয়াকারের কথা।
এ কি সান ওয়াকারের চিৎকার?
থমকে দাঁড়াল। তাকাল দরজার দিকে। এই দরজার ভেতর থেকেই আসছে চিৎকারটা।
সে ভেতরে প্রবেশ করবে কিনা, ভাবল আহমদ মুসা।
অবস্থার নাজুকতার দিক বিচার করার এবং এক মুহূর্ত নষ্ট করার অবকাশ নেই। সুতরাং কোন কিছুর দিকে না তাকিয়ে প্রথম তাকে শুত্রু পুরি থেকে বের হওয়া দরকার।
কিন্তু পরক্ষণেই কোরআন শরীফের একটা আয়াতের কথা তার মনে পড়ল। যাতে মযলুম মানুষের ফরিয়াদে সাড়া দেয়াকে অপরিহার্য করা হয়েছে।
আহমদ মুসা দাঁড়াল দরজার দিকে।
এখানেও আলফাবেটিক্যাল লক। আহমদ মুসা রিভারবাল পকেটে রেখে ডান হাতে স্টেনগান নিয়ে বাম হাত দিয়ে লক-এর কি-বোর্ডে টাইপ করল ‘হোয়াইট ঈগল’
দরজা খুলে গেল সংগে সংগে।
ভেতরে প্রবেশ করে আহমদ মুসা উদ্বেগের সাথে দেখল, সান ওয়াকার ছাদের সাথে উবু করে টাঙ্গানো। চোখ-মুখ রক্তের মত লাল। চোখ দুটি যেন তার বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
আহমদ মুসা সান ওয়াকারকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে গুলি করল চামড়ার দড়িটায়।
সান ওয়াকার গড়িয়ে পড়ল আহমদ মুসার হাতে। দুর্বল কণ্ঠে বলল সান ওয়াকার, পানি, পানি চাই।
আহমদ মুসা ঘরে চারদিকে চাইল। পানি কোথাও নেই। বলল, একটু ধৈর্য ধরতে হবে সান ওয়াকার। এখানে থেকে না বেরুলে পানি পাওয়া যাবে না।
সান ওয়াকারের দাঁড়াবার শক্তি নেই আহমদ মুসা তাকে কাঁধে তুলে নিল। বাম হাতে তাকে ধরে রেখে ডান হাতে স্টেনগান বাগিয়ে কক্ষ থেকে বেরুচ্ছিল। পূর্ব দিক থেকে কতকগুলো। পায়ের শব্দ ছুটে আসার শব্দে আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল। উঁকি দিয়ে দেখল, স্টেনগান বাগিয়া ছুটে আসা চারজন দাঁড়াল আহমদ মুসার বন্দিখানার দরজায়, যেখানে এখন বন্দী আছে গোল্ড ওয়াটার, জেনারেল শ্যারণ এবং অন্যান্যরা।
ওরা দরজা খুলতে যাচ্ছে।
ওদের সমস্ত মনোযোগ দরজার দিকে।
আহমদ মুসা বাম পা করিডোরে নামিয়ে পূর্বমুখী হয়ে স্টেনগান পাঁজরে চেপে ডান হাতে ট্রিগার টিপল স্টেনগানের।
ওদের দু’জন শেষ মুহূর্তে দেখতে পেয়েছিল। স্টেনগান ঘুরিয়েও নিয়েছিল ওরা। কিন্তু ততক্ষণে আহমদ মুসার স্টেনগানের গুলীর ঝাঁক ওদের ঘিরে ধরেছে।
আহমদ মুসা গুলী করেই আবার ছুটল করিডোর ধরে পশ্চিম দিকে বাইরে বেরুবার পেছনের দরজা লক্ষে।
করিডোরের শেষ মাথাটা দেখা যাছে আরও কিছুটা পশ্চিমে।
দক্ষিণ দিকে চলে যাওয়া একটা শাখা। করিডোরের মুখে তখন সে।
বেশ পেছন থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল ‘ঐ যে যায়।
শুনেই আহমদ মুসা পশ্চিমমুখী যে ধামটা টা আর না ফেলে নিজের দেহটাকে কাত করে ছুড়ে দিল দক্ষিণের করিডোরে।
ঠিক সে সময়েই এক ঝাঁক গুলী চলে গেল করিডোর দিকে। তারা দাঁড়িয়ে থাকলে তাদের দু’জনের দেহটাই ঝাঁঝরা হয়ে যেত।
আহমদ মুসা পড়ে যাবার পর সান ওয়াকারের দেহটা ছিটকে গিয়েছিল তার উপর থেক।
আহমদ মুসার বাম কপালটা ঠুকে গিয়েছিল করিডোরের মেঝের সাথে। ছিঁড়ে গিয়েছিল কপাল। রক্ত নেমে এসেছিল কপাল থেকে।
ব্যাথা সামলাবার জন্যে আহমদ মুসা বাম হাতে কপালটা চেপে ধরে পড়ে যাবার সংগে সংগেই আবার উঠে দাঁড়াল। দ্রুত এগিয়ে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল পূর্ব-পশ্চিম করিডোরের দিকে। দেখল ছুটে আসছে তিনজন স্টেনগান বাগিয়ে। মাঝে মাঝে গুলী করছে।
আহমদ মুসা স্টেনগান ঘুরিয়ে নিল ওদের দিকে। অপেক্ষা করল ওদের গুলীর বিরতির সময়টুকুর জন্যে।
সময়টা আসতেই আহমদ মুসা স্টেনগানের মাথা দেয়ালের আড়ালের থেকে বের করে নিজেও কিছুটা এগিয়ে ট্রিগার টিপল স্টেনগানের।
ওদের আড়াল নেবার কোন আশ্রয় ছিল না। অসহায়ভাবে একঝাক গুলীর শিকার হল তিনজনই।
আহমদ মুসা পশ্চিমমুখী করিডোরে আর ফিরে না গিয়ে দক্ষিণের করিডরে ধরে এগুনোর সিদ্ধান্ত নিল। তার মনে পড়ল আঁকা বাঁকা করিডোরের শেষ প্রান্তে পেছনের দরজা দেখেছিল সে গোল্ড ওয়াটারের মিনি টিভি স্ক্রীনে।
উঠে দাঁড়িয়েছিল সান ওয়াকার।
আহমদ মুসা তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে গেল।
ধন্যবাদ। কষ্ট হলেও পারব হাঁটতে। বলল সান ওয়াকার।
ধন্যবাদ সান ওয়াকার। চল পেছনের দরজা আমাদের খুজে বের করতে হবে। পালানোর এটাই হবে সহজ পথ।
বলে আহমদ মুসা সান ওয়াকারের একটা হাত ধরে দ্রুত এগুলো দক্ষিণ দিকে।
সান ওয়াকার আহমদ মুসার হাতের উপর শরীরের অনেকখানি ভার ন্যাস্ত করে চলতে লাগল আহমদ মুসার সাথে।
একটু এগিয়ে করিডর পশ্চিম দিকে মোড় নিয়েছে।
পশ্চিম দিকে চলল আহমদ মুসা। কিন্তু কয়েকগজ এগিয়ে সামনে তাকিয়ে হতাশা ও উদবগে ছেয়ে গেল তার মন। করিডোরের সামনে একটা ঘরের দরজা গিয়ে শেষ হয়েছে। সে চায় উপরে উঠার সিঁড়ি দরজা দিয়ে সে কি করবে।
থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
ভাবল পেছনে ফিরে আবার পশ্চিমমুখী সেই করিডরে ফিরে যাবে নাকি!
এসময় আহমদ মুসা পিছনে ফেলে আসা করিডরে গুলীর শব্দ অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পিছনে ফেরার কোন উপায় নাই।
সামনেই তাকে এগুতে হবে। ভাগ্যই যেন তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঠেলে নিয়ে চলছে।
দ্রুত এগিয়ে আহমদ মুসা ঘরটির দরজায় দাঁড়াল। এখানেও সেই আলফাবেটিক্যাল লক।
লকের কী-বোর্ড নক করতে করতে আহমদ মুসা ভাবল, আবার সে নিজ হাতে আরেক বন্দীখানায় প্রবেশ করছে কিনা।
কিন্তু উপায় নাই।
ঈগল-এর ‘L’ এ নক হবার সাথে সাথেই খুলে গেল দরজা।
সান ওয়াকারকে প্রথমে ঘরে ঢুকিয়ে নিজে ঘরে প্রবেশ করল। প্রবেশ করেই দরজা লাগিয়ে দিল।
গুলী এবং ছুটে আসা পায়ের শব্দ অনেক কাছে এসেছে।
দরজা লাগিয়েই আহমদ মুসা দরজা বন্ধ করার উপায় তালাশ করতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসার নজরে পড়ল দরজা বন্ধ করার আলীশান ব্যবস্থা।
দরজা সিটকানি ছাড়াও রয়েছে দুই চৌকাঠে আইরন বার দিয়ে দরজা বন্ধ করার গর্ত। মোটা একটা আইরন বারও ঝুলছে দরজার চৌকাঠের সাথে।
আহমদ মুসা দরজার সিটকানি বন্ধ করে আইরন বারটিও লাগিয়ে দিল।
দরজাও দেখল সে লোহার।
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করার এ ব্যবস্থা দেখে প্রথমে বিস্মিত হয়ে ছিল আহমদ মুসা, কিন্তু পরক্ষণেই ভেবে খুশি হল যে, এই ঘর কোন বন্দীখানা নয়। নিশ্চয় এটা আত্মরক্ষামূলক ঘর। না হলে দরজাটা লোহার এবং ভেতর থেকে ডাবল প্রটেকশনের ব্যবস্থা থাকবে কেন?
কিন্তু একটা ঘরে এই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা কেন? একটা ঘরে এভাবে আশ্রয় নিলে আত্মরক্ষা করা যায় না।
পরবর্তী আত্মরক্ষার ব্যবস্থা হিসাবে এ ঘর থেকে নিরাপদ কোন পথে বাইরে যাবার উপায় অবশ্যই থাকতে হবে।
হঠাৎ আহমদ মুসা হলো পেছনের দরজায় পৌছার পথে এটা কোন ঘর নয় তো।
কিন্তু চারিদিকে চেয়ে চার দেয়ালে কোন দরজা দেখতে পেল না।
নিরেট পাথরের দেয়াল।
কিন্তু আহমদ মুসার মন বলল একটা দরজা থাকতেই হবে কোন দেয়ালে।
আহমদ মুসা স্টেনগানের বাঁট দিয়ে দেয়ালে আঘাত করতে লাগল।
উত্তর ও পশ্চিম দেয়ালে ব্যর্থ হবার পর দক্ষিণ দেয়ালে আঘাত করতে লাগল।
দেয়ালের পাশ ঘেঁষে হাঁটছিল আর আঘাত করছিল আহমদ মুসা।
দরজার বাইরে পায়ের শব্দ, গুলিরও শব্দ। সান ওয়াকারের মুখ ভয় ও উদ্বেগে ফ্যাঁকাসে হয়ে উঠেছিল। অসহায় দৃষ্টি তার আহমদ মুসার প্রতি।
অসাধারণ ও অস্বাভাবিক মানুষটি কি শেষ রক্ষা করতে পারবে? পারবে কি তারা বাইরে বেরুতে।
আহমদ মুসা দক্ষিনের দেয়ালে স্টেনগানের বাঁট দিয়ে আঘাত করতে করতে দেয়ালের মাঝামাঝি এক জায়গায় এসে দাঁড়াতেই ভোজবাজির মত দেয়ালটা ফাক হয়ে দু’দিকে সরে গেল এবং বেরিয়ে পড়ল উপরে উঠার একটা সিঁড়ি পথ।
আহমদ মুসা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেলল।
সান ওয়াকার নতুন প্রাণ পাওয়ার মত সজীব হয়ে উঠেছ। আহমদ মুসার প্রতি তার অসীম কৃতজ্ঞ দৃষ্টি।
এস সান ওয়াকার’ বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল।
সান ওয়াকারের দুর্বল শরীর। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে তার কষ্ট হচ্ছিল। দেখে আহমদ মুসা কয়েক ধাপ নেমে এসে তার হাত ধরে টেনে তুলতে লাগল। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে দেখল অন্যন্ত পুরু ইস্পাতের প্লেট দিয়ে তৈরী ঢাকনা দিয়ে সিঁড়ির মুখ বন্ধ।
আহমদ মুসা দেখেই বুঝল, হুড়কো বা সিটকানি জাতীয় কিছু দিয়ে ঢাকনাটি বন্ধ করা নয়। তাহলে নিশ্চয় দরজা খোলার ইলেকট্রনিক কোন ব্যবস্থা আছে ভাবল আহমদ মুসা।
অন্যসব দরজায় ইলেকট্রনিক লকের সব কী-বোর্ড খুজতে লাগল আহমদ মুসা।
খুজল দরজা এবং তার চারপাশে। না কিছুই নেই। তারপর দেখল সিঁড়ির ল্যান্ডিং এবং তিন দিকের দেয়ালে। প্রথম সন্ধানে লকের কী-বোর্ড ধরণের কছুই চোখে পড়ল না।
নিচে দরজায় তখন প্রবল ধাক্কা। দরজা ভাঙার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সান ওয়াকারের দুর্বল শরীর কাঁপছে তখন। বলল, ‘দরজা খোলার কোন উপায় পাওয়া যাচ্ছা না।
‘আল্লাহ একটা উপায় বের করে দিবেনই’ বলে আহমদ মুসা আবার চারদিকে চোখ বুলাতে শুরু করল।
এক জায়গায় এসে তার চোখটা আটকে গেল। দেখল, দেয়ালের এক জায়গায় পেন্সিলের অস্পষ্ট আঁচড়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত আঁকা।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল গ্রীকদের ধাধার প্রাসাদের কাহিনী।
যেখানে ছবির ইংগিত অনুসরণ করে পথ সন্ধান করে ধাঁধার চক্র ভেঙ্গে ফেলা হয়।
এই চিন্তার সাথে সাথে আহমদ মুসা মুষ্টিবদ্ধ ছবির উপর একটা মুষ্ট্যাঘাত করল। সংগে সংগে তার পাশের দেয়াল ফুড়ে বেরিয়ে এল ইলেকট্রনিক লক-এর কী বোর্ড।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠক আহমদ মুসার। কী বোর্ডটি আগের গুলোর মতই আলফাবেটিক্যাল।
আহমদ মুসা মুহূর্ত দেরী না করে কী-বোর্ডে টাইপ করল আগের মতি।‘হোয়াইট ঈগল’ কিন্তু দরজা খুলল না।
বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আহমদ মুসার। ভাবল, এখানে তাহলে ভিন্ন ‘বোর্ড’ ব্যবহার করা হয়েছে। কি সে বোর্ড? এতক্ষণে প্রবল একটা হতাশা এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে।
কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যে। পর মুহূর্তেই সান ওয়াকারের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমাদের ধর্মে আছে, আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে কখনও হতাশ হতে নেই। দেখ একটা একটা পথ আল্লাহ বের করে দিবেনই।
হঠাৎ আহমদ মুসার চোখে পড়ল কী-বোর্ডের মাথার হোয়াইট ঈগলের একটা অস্পষ্ট ছবি। সাদা বোর্ডের উপর সাদা ঈগলটি পা উপরে তুলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।
দেখেই আহমদ মুসা বুঝল ছবিটি নিরর্থক নয়। কিন্তু ছবিটি এমন অস্বাভাবিক কেন? কোন ইংগিত দিচ্ছে কি ছবিটি?
মুহূর্ত কয়েক ভাবল আহমদ মুসা।
হঠাৎ তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দ্রুত ‘কী বোর্ডের উপর আবার আঙ্গুল চালাল আহমদ মুসা। এবার টাইপ করল পরের শব্দটা আগে এনে। ঈগল হোয়াইট টাইপ করার সাথে সাথেই সিঁড়ি মুখের দরজা নিঃশব্দে সরে গেল।
স্টেনগান বাগিয়ে আহমদ মুসা আগে উঠল সিঁড়ি থেকে উপরে। গোল্ড ওয়াটারের টিভি স্ক্রীনে দেখা সেই একতলার ছাদ এটা।
ছাদের চারদিকে ভাগাড়, ময়লা আবর্জনা ভর্তি। তার চারদিক দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া। চারদিকে আবর্জনার মধ্যে ছোট এক তলাটি পরিত্যক্ত এক আবর্জনার মতই দাঁড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা দেখল, ছাদ থেকে একটা সিঁড়ি ঘরের ভিতরে নেমে গেছে।
আহমদ মুসা সান ওয়াকারকে হাত ধরে টেনে উঠল। তারপর তার হাত ধরেই সিঁড়ি দিয়ে ঘরের ভেতরে নামল।
ঘরের মেঝে পাকা। ধুলোবালি ছাড়া অন্য কোন আবর্জনা নেই।
মেঝেতে নেমেই আহমদ মুসা দেখতে পেল, ঘরের পশ্চিম পাঁশের দেয়ালে একটা সুড়ঙ্গ।
আহমদ মুসা উঁকি দিয়ে দেখল, সুরঙ্গটি একটা কনক্রিটের পাইপের মধ্য দিয়ে বেয়ে গেছে। এটাই কি এখান থেকে বের হবার পথ? এইসময় ঠিক ঘরটির ছাদেই পায়ের শব্দ শুনতে পেলে আহমদ মুসা।
ওরা এসে গেছে আর এক মুহূর্ত দেরী করা যায় না।
আহমদ মুসা সান ওয়াকারকে সুড়ঙ্গ দেখিয়ে বলল, ‘এর ভিতর দিয়ে যেতে পারবে তো?’
‘আপনি ভাববেন না, আমি পারব।’ বলল সান ওয়াকার।
সান ওয়াকারকে ঢুকে গেল আগে। আহমদ মুসা পিছনে।
আহমদ মুসা সুড়ঙ্গে ঢুকে ঘরের দিকে স্টেনগান বাগিয়ে বসল।
সান ওয়াকার কিছুটা এগিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি আসছেন না যে?’
‘ওরা এসে গেছে। আমি ওদের আটকাই। তুমি এগোও। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারব।’ আহমদ মুসা বলল।
সান ওয়াকার আবার চলতে শুরু করল।
ওরা ঝড়ের বেগে সিঁড়ি দিয়ে ঘরের মেঝেয় নামল। ছয়জন ওরা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওরা এগুলো সুরঙ্গের দিকে।
ভেগেছে ওরা সুরঙ্গ দিয়ে। ব্যাটা যাদুকর নাকি! কোন বাঁধাই তাকে আটকতে পাড়ল না। বলল ওদের একজন।
কথা নয় এস তোমরা। শয়তান যাবে কোথায়? বলল ওদের সামনের নেতা গোছের লোকটি। ওরা এল সুরঙ্গের সামনে।
‘এস, শয়তান কোথাও যায়নি।’ বলে আহমদ মুসা সুরঙ্গের মুখে এসে স্টেনগানের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে ঘুরিয়ে নিল অর্ধচন্দ্রাকারে।
ওরা ছয়জন ভুত দেখার মত চমকে উঠল। স্টেনগান ঘুরিয়ে নিচ্ছিল ওরা।
আহমদ মুসা প্রস্তুত স্টেনগান তার আগেই অগ্নি বৃষ্টি করল।
ঝরা পাতার মত মাটিতে আছড়ে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল ওদের ছয়টি দেহ।
আহমদ মুসা মুহূর্ত কয়েক অপেক্ষা করল। না কোন শব্দ আসছে না। ওদের পিছনে যারা আসছে। তারা এসে পৌঁছায়নি এখনও। ওরা আসার আগেই তাকে সুরঙ্গ পার হতে হবে। ভাবল আহমদ মুসা। তারপর ছুটল সুরঙ্গ ধরে ক্যাঙ্গারুর মত লাফিয়ে লাফিয়ে। সুরঙ্গের মুখ একটা ঝোপে এসে শেষ হয়েছে।
আহমদ মুসা সুরঙ্গ থেকে বের হয়ে দেখল, ঝোপের মধ্যে শুয়ে পড়েছে সান ওয়াকার। হাঁপাচ্ছে সে। হামাগুড়ি দিয়ে আসতে কষ্ট হয়েছে তার।
আর দেরী করা যাবে না।
আহমদ মুসা কাঁধে তুলে নিল সান ওয়াকারকে। ছুটল তারপর গাছ-গাছড়ার মধ্য দিয়ে।
সামনেই পশ্চিম দিকে গাড়ি চলাচলের শব্দ কানে আসছে।
নিশ্চয় রাস্তা খুব কাছে।
রাস্তা লক্ষ করে ছুটল আহমদ মুসা সান ওয়াকারকে কাঁধে নিয়ে।
রাস্তার পাশে পার্কিং কর্ণারে গাড়ি পার্কিং করে বসে আছে মেরী রোজ।
মেরী রোজ ও শিলা সুসান দু’জনে দুই গাড়ি নিয়ে এসেছে।
গাড়ি নিয়ে তারা দু’জন গোল্ড ওয়াটারের বাড়ির (হোয়াইট ঈগল-এর হেড কোয়ার্টার)আশে পাশে একটা চক্কর দেয়ার পর শিলা সুসান গাড়ি নিয়ে মেরী রোজকে এখানে দাঁড়াতে বলে ফিরে গেছে সে গোল্ড ওয়াটারের বাড়ির সামনে।
বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে মেরী রোজ।
শিলা সুসান যাবার পর আধ ঘন্টা হয়ে গেছে। এতক্ষন সে কোন কাজে দেরী করবে, কোথায় দেরী করবে?
এদিক ওদিক পায়চারী করে আবার সে গাড়ির সিটে এসে বসল। ভাবল সে, অপেক্ষা করার মত কঠিন কাজ কিছু নেই। তবু ভালো লাগছে তার এই ভেবে যে সান ওয়াকারের জন্যেই সে এখানে এসেছে, তার জন্যে কষ্ট করা আসলেই আনন্দের।
সান ওয়াকারের কথা মনে হতেই বেদনায় জর্জরিত হয়ে গেল তার মন। মনে পড়ে গেল তার অতীতের কথা। অত্যন্ত প্রতিভাবান লাজুক এই রেড ইন্ডিয়ান তরুনকে সে কত কষ্ট দিয়েছে, নানাভাবে নাজেহাল করেছে ঘৃণাসুচক ‘কালার’ড নামে ডেকে। কোনদিন কোনকিছুরই প্রতিবাদই করেনি সে। সবকিছুর জবাবে এমনভাবে হেসেছে যেন সেই বিজয়ী আর মেরী রোজ পরাজিত। সে যেন শক্ত এক পাথর। ঘৃণার যে বুলেটই মেরী রোজ ছুড়েছে, সব বুমেরাং হয়ে ফেরত এসেছে মেরী রোজের কাছেই। শেষে মেরী রোজ সত্যিই পরাজিত হয়েছে। নিজের অজান্তেই কখন যেন তার হৃদয় বাধা পড়ে গেছে সান ওয়াকারের কাছে। সমগ্র সত্ত্বা দিয়ে সে ভালোবেসে ফেলেছে সান ওয়াকারকে। যেদিন সে প্রথম এটা বুঝল, অনেক কেঁদেছে সেদিন। কেঁদেছে সে তার অমুলক বর্ণবাদী অহংকারের জন্য। সোজা গিয়ে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে সান ওয়াকারের কাছে। সান ওয়াকার অতীতের দিকে একটুও না তাকিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছে মেরী রোজকে। আবেগে কেঁদে ফেলে বলেছে, ‘রোজ, আমি এ দিনেরই অপেক্ষা করেছি।’
ভাবতে ভাবতে মেরী রোজ-এর চোখ দু’টি অশ্রুসজল হয়ে উঠল।
অতীতের স্মৃতির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে মেরী রোজ।
পেছনে শব্দ ও গাড়ির ঝাঁকুনীতে সম্বিত ফিরে পেল মেরী রোজ।
চোখ তুলতেই সে দেখতে পেল স্টেনগানধারী একজন যুবককে। সেই গাড়ির পেছনে কাউকে শুইয়ে দিয়েছে। সেদিকে তাকাতেও সাহস পেলনা মেরী রোজ।
দ্রুত এগিয়ে আসছে যুবকটি তার দিকে।
যুবকটি এগিয়ে এসে স্টেনগানের ব্যারেলটি তার দিকে তুলে বলল, ‘গাড়ি আমাদের দরকার, আপনি সহোযোগিতা করুন। আপনি ঠিক সিটে বসে থাকুন। আমি ড্রাইভিং-এ বসছি।’
বলেই যুবকটি একলাফে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসল। বসতে বসতে বলল, ‘কোনও প্রকার অসহোযোগিতা করলে কিন্তু আমি গুলি করতে বাধ্য হবো। নিশ্চিত থাকুন আপনার কোন ক্ষতি হবে না।’
গাড়ি স্ট্রার্ট দিল যুবকটি।
কিন্তু গাড়ি চলতে শুরু করার আগেই পেছনে ব্রাশফায়ারের শব্দ হলো।
যুবকটি মাথা নিচু করল এবং মেয়েটিকে সিটে শুয়ে পড়তে বলল।
লাফিয়ে উঠে চলতে শুরু করেছে গাড়ি। তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে গাড়ি। গুলীর শব্দ তখন অনেকটা পেছনে গেছে। কিন্তু গাড়ির গতি স্লো হয়নি।
গুলীর হাত থেকে বাঁচলেও গাড়ির গতি দেখে আতংকিত হলো মেরী রোজ। এভাবে চললে হয় এ্যাকসিডেন্ট করবে, নয়তো পুলিশের হাতে পড়তে হবে। পুলিশের হাতে পড়লে তার জন্যে ভাল। কিন্তু এ্যাকসিডেন্ট করলে জীবন বাঁচবে না।
কিন্তু বিস্মত হলো মেরী রোজ যে, যুবকটি অবিশ্বাস্য দক্ষতার সাথে নিজে বেঁচে এবং সবাইকে বাঁচিয়ে এগিয়ে চলছে ঝড়ের গতিতে। রাস্তার বাঁক অতিক্রম কালে তার দক্ষতা দেখার মত। যেন গাড়ি তার কাছে হাতের একটা খেলনা। যখন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা, যতটা ইচ্ছা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিচ্ছে।
মিনিট সাত আট চলার পর যুবকটি গাড়ির গতি কিছুটা স্লো করল। বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার গাড়িতে পানি দেখেছি। পানি কি নিতে পারি? আমার অসুস্থ বন্ধুটি ভয়ানক তৃষ্ণার্ত।’
মেরী রোজ মনে মনে বলল, যুবকটি যেই হোক, ভদ্র। চেহারায় ক্রিমিনাল নয়, শরীরে ভদ্রলোকের ছাপ। কথাও পোশাকী ভদ্রগোচের নয়, কথার মধ্যে সম্মান ও আন্তরিকতার ছাপ আছে।
যুবকটির কথার উত্তর না দিয়ে মেরী রোজ তাকাল পেছনে শুইয়ে রাখা যুবকটির বন্ধুটির দিকে।
পেছনে তাকিয়ে আর্তচিৎকার করে উঠল মেরী রোজ, ‘সান ওয়াকার তুমি! একি তোমার হাল!’
বলে মেরী রোজ লাফ দিয়ে সিট ডিঙ্গিয়ে পেছনে চলে গেল। ঝাঁপিয়ে পড়ল সান ওয়াকারের বুকে।
এতক্ষণ সান ওয়াকার চোখ বুঝে পড়েছিল। মেরী রোজ-এর চিৎকারে সে চোখ খুলল। জড়িয়ে ধরল বুকে ঝাঁপিড়ে পড়া মেরী রোজকে।
বিস্মিত আহমদ মুসা মহুর্তেই বুঝল, নিশ্চয় মেয়েটি সান ওয়াকারের স্ত্রী বা কোন একান্ত আপনজন। খুশি হল এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। এই মহুর্তে সান ওয়াকারের একটা নিরাপদ আশ্রয় প্রয়োজন।
ওদিকে মেরী রোজ-এর অনেক কথার জবাবে সান ওয়াকার বলল, ‘মরেই যাচ্ছিলাম, অপরিচিত ঐ মহান যুবকটি মৃত্যুর সাথে লড়াই করে অসম্ভবকে সম্ভব করে আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।’
‘সান ওয়াকার ঈশ্বরকে ডাক। এখনও বিপদ কাটেনি। পেছনে মনে হচ্ছে ওদের কয়েকটা গাড়ি পাগলের মত ছুটে আসছে।’
বলেই আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পীডও বাড়িয়ে দিল।
সান ওয়াকার ও মেরী রোজ দু’জনেই পেছনে তাকাল। দেখল ঠিকই দুরে কয়েকটা গাড়ি একই গতিতে পাগলের মত ছুটে আসছে।
দু’জনের মুখই ভয় ও উদ্বেগে পাংশু হয়ে গেল।
‘সান ওয়াকার তোমার তৃষ্ণা কি এখনও আছে?’ পেছনে না তাকিয়েই ঠোঁটে হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথায় মেরী রোজ তাকাল সান ওয়াকারের দিকে। বলল, ‘স্যরি ভুলে গেছি। দিচ্ছি পানি।’
বলে মেরী রোজ ড্যাশবোর্ডে রাখা বোতল নিয়ে পানি খাওয়াবার জন্যে এগুলো সান ওয়াকারের দিকে।
পানি খেয়ে সান ওয়াকার কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘আপনি কে, জানিনা বন্ধু, কিন্তু ঈশ্বর আপনাকে তার দয়ার সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন। সবদিকেই আপনি সমান নজর রাখতে পারেন।’
আহমদ মুসা সান ওয়াকারের কথার দিকে কোন কান না দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, সান ওয়াকারকে কোথায় নিতে পারি?’
বিপদে পড়ল মেরী রোজ। কোথায় নিতে বলবে সান ওয়াকারকে? বিশ্ববিদ্যালয় কি তার জন্যে নিরাপদ? না। পুলিশের আশ্রয় নেবে? তাও নিরাপদ নয়। পুলিশের আশ্রয় থেকে ওরা সান ওয়াকারকে নিয়ে যাবে। নিজের বাড়িতে নেবে সান ওয়াকারকে মেরী রোজ? সেটাও সম্ভব নয়। তার আব্বা এসব হাঙ্গামা থেকে মেরী রোজকে দুরে থাকতে বলেছেন। কোন উত্তর খুঁজে পেলনা মেরী রোজ। অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল সে সান ওয়াকারের দিকে। অশ্রুতে ভরে উঠেছে তার চোখ। নিজের দেশ নিজের নগরীতে কোন নিরাপদ স্থান খুঁজে পেল না সান ওয়াকারের জন্যে।
সান ওয়াকারও নির্বাক।
আহমদ মুসাই কথা বলল আবার। বলল, ‘আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন। আমাকে শহর থেকে বেরুবার পথ বলে দিন।’
মেরী রোজ চোখ মুছে বলল, ‘যে পথ দিয়ে চলছেন, সে পথ দিয়ে সোজা পশ্চিমে এগুলে পটোম্যাক নদীর ব্রীজে পৌছা যাবে। ব্রীজ পেরোলেই অরলিংটন, প্রবেশ করা যাবে ভার্জিনিয়ায়।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা রিয়ার ভিউ-এর দিকে একবার তাকিয়ে সামনের দিকে মনোযোগ দিল।
অনুসরণকারী গাড়ি বলে যাদের সন্দেহ তারা একই দুরুত্বে রয়েছে।
পটোম্যাক ব্রীজ পার হয়ে অরলিংটন সমাধি ভুমিকে বামে রেখে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এগিয়ে চলল আহমদ মুসার গাড়ি।
এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলল সে।
মেরী রোজ-এর গাড়িটি নতুন এবং আমেরিকান গাড়ি। স্পীড ভালো। সুতরাং পেছন থেকে এসে ওরা ধরে ফেলবে, এ সম্ভাবনা কম। আবার সামনে থেকে এসে ঘিরে ফেলবে, নগরী থেকে বেরুবার পর এ সম্ভাবনাও কমে গেছে। কিন্তু এভাবে প্রতিযোগিতার দৌড়ে বাঁচা তো সমস্যার সমাধান নয়।এসব চিন্তা করে বলল আহমদ মুসা, ‘সান ওয়াকার, ওরা আমাদের পিছু ছাড়বেনা।’
‘তাই তো দেখা যাচ্ছে।’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল মেরী রোজ।
‘ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সরে পড়া ও তো সম্ভব নয়।’ আহমদ মুসা বলল অনেকটা স্বগত কন্ঠে।
‘তাহলে।’ বলল মেরী রোজ শুকনো কন্ঠে।
‘লড়াইয়ে নামা ছাড়া পথ নেই। তবে ভয় নেই, যুদ্ধ ঘোষণা আমরা করব, সেহেতু যুদ্ধের নেতৃত্ব আমাদের হাতেই থাকবে।’
‘কিন্তু তিন গাড়িতে ওরা অনেক লোক হবে।’ বলল মেরী রোজ ভীত কন্ঠে।
‘ভয় নেই আমাদের হাতে এখন দু’টি স্টেনগান। আর সংখ্যা শক্তি আধুনিক যুদ্ধ জেতার নিয়ামক নয়।’
মেরী রোজ ও সান ওয়াকার বিস্মিত চোখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। শুরু থেকেই মেরী রোজ দেখছে, বিপদে পড়ার কোন চাপ আহমদ মুসার মুখে নেই। বিপদটা যেন তার কাছে খেলা।এখন লড়াইয়ে নামার কথা এমনভাবে বলছে যেন যুদ্ধে কি হবে তা নিশ্চিতভা্বেই জানে। অন্যদিকে সান ওয়াকার ভাবছে, সাধারণ মাপের এই অসাধারণ যুবকটি কে? লড়াই সম্পর্কে সে যে কথা বলছে তার বিন্দু বিসর্গও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না। যে লড়াই করে সে হোয়াইট ঈগলের ঘাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে, তাতে করে তার অসাধ্য কিছুই নেই।
হঠাৎ আহমদ মুসা উৎকর্ণ হয়ে উঠল।
পর মুহূর্তেই আহমদ মুসা পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘পেছন থেকে বড় একটা বিপদ আসছে সান ওয়াকার।’
মেরী রোজ ও সান ওয়াকার দু’জনেই পেছন দিকে তাকাল উদ্বিগ্ন চোখে। কিছুই না দেখে বলল সান ওয়াকার, ‘কি বিপদ, কিছুই তো দেখছি না তিনটি গাড়ি ছাড়া।’
‘কান পেতে শোন হেলিকপ্টার আসছে।’
সান ওয়াকার ও মেরী রোজ দু’জনেই উৎকর্ণ হয়ে পর মুহূর্তে বলল, ‘হ্যাঁ দূরে হেলিকপ্টারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাতে কি?’
‘শুধু গাড়ি নয়, এবার হেলিকপ্টারও আমাদের পিছু নেবে। হেলিকপ্টার দিয়ে রোড ব্লক করে আমাদের ধরতে চেষ্টা করবে অবশেষে।’
মুহূর্তে মেরী রোজ ও সান ওয়াকারের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। ভয় ও উদ্বেগে পাংশু হয়ে উঠল তাদের মুখ।
হেলিকপ্টারের শব্দ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আরও কয়েক মুহূর্ত পর দূর দিগন্তে একটি ছুটে আসা হেলিকপ্টারের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল।
ভাবছিল আহমদ মুসা। সান ওয়াকার ও মেরী রোজ উদ্বেগ-আতংক নির্বাক। তারা জানে, হেলিকপ্টারের সাথে পাল্লা দিয়ে গাড়ি পারবে না। মেরী রোজ-এর মনে পড়ল মার্কিন গোয়েন্দাদের একটা বাস্তব অপারেশনের কাহিনীর কথা। সে কাহিনীতে গোয়েন্দা হেলিকপ্টারের শক্তিশালী চুম্বক রশি নিচে পলায়নপর ক্রিমিনালদের গাড়ি আটকে ফেলেছিল শূন্যে তুলে নিয়ে। হোয়াইট ঈগলের মত সংস্থার এ ধরনের ব্যবস্থা তো থাকতেই পারে।
মেরী রোজ অসহায়ভাবে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। সান ওয়াকারও।
আহমদ মুসার দিকে গভীরভাবে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মেরী রোজ-এর মনে পড়ল শিলা সুসানের কাছে শোনা আহমদ মুসার কথা। চমকে উঠল মেরী রোজ, এ যুবকটিই আহমদ মুসা নয়তো? সে না হলে এ আর কে হবে? বিশেষ করে যুবকটি যখন এশিয়ান চেহারার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন এই প্রথম সে আর তারা আশাও করছিল আহমদ মুসাই সান ওয়াকারকে উদ্ধার করতে পারে বন্দীখানা থেকে।
আহমদ মুসাকে আহমদ মুসা বলে ভাবতে গিয়ে মেরী রোজ-এর মনে আশার সঞ্চার হলো। সে শিলা সুসানের কাছে শুনছে, আহমদ মুসা অসাধ্য সাধন করতে পারে। সে নিশ্চয় বাঁচার একটা পথ বের করবেই।
মেরী রোজের চিন্তা আর এগুতে পারল না। আহমদ মুসা একটু মুখ ঘুরিয়ে মেরী রোজ ও সান ওয়াকারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমরা কিছু ভাবছ?’
‘আমরা কিছুই ভাবতে পারছি না।’ বলল সান ওয়াকার।
‘একটাই পথ, আমি নিরাপদ জায়গা দেখে তোমাদের নামিয়ে দেব এবং গাড়ি নিয়ে আমি সামনে এগিয়ে যাব। হেলিকপ্টার ও গাড়িগুলো আমাকে তাড়া করে চলে গেলে তোমরা পালাবার ব্যবস্থা করবে।’
মেরী রোজ ও সান ওয়াকারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সত্যিই তারা বাঁচতে পারে। কিন্তু পরক্ষনেই নিভে গেল তাদের মুখের আলো। বলল মেরী রোজ, ‘আমাদের বাঁচার ব্যবস্থা হলো, কিন্তু আপনি তো ধরা পড়ে যাবেন।’
‘সবাই এক সাথে বাঁচার চেষ্টা করলে সবাই ধরা পড়ে যাব। ভয় নেই, তোমাদের বাঁচাটা নিশ্চিত হবার পর আমি বাঁচার চেষ্টা করব। চেষ্টা সফল না হলে হয়তো ধরা পড়ব। কিন্তু তাতেও একটা লাভ হবে, সবাই ধরা পড়লাম না।’
স্তম্ভিত হয়ে গেল মেরী রোজ ও সান ওয়াকার দু’জনেই আহমদ মুসার কথা শুনে। নিজের ধরা পড়ার কথা এমনভাবে, এমন নিরুদ্বিগ্ন মুখে বলল যেন ধরা পড়াটা কোন ব্যাপারই নয়। অথচ মেরী রোজ জানে, বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করা হবে আহমদ মুসাকে তার চরম শত্রু ইহুদী গোয়েন্দাদের কাছে। মনে কষ্ট লাগল মেরী রোজ-এর। বলল, ‘সব বিপদ আপনার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে আমরা কেমন করে সরে পড়ব?’
আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘দেখ, আমি এখন তোমাদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছি। আমার দেয়া সিদ্ধান্ত তোমাদের মানতে হবে। তাছাড়া সান ওয়াকার অসুস্থ। তার নিরাপত্তাই প্রথম বিবেচ্য। আর তার সাথে তুমি না থাকলে সে একা বিপদে পড়বে নিজেকে নিয়েই। সুতরাং তোমাদের দু’জনকেই নামতে হচ্ছে।’
বলে আহমদ মুসা একটা দম নিয়ে তাদেরকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে আমরা টিলা, আঁকা-বাঁকা ও বনবাদাড় পূর্ণ রাস্তায় প্রবেশ করতে যাচ্ছি। তোমাদের একটা ভালো জায়গায় নামিয়ে দেব। হেলিকপ্টার ও শত্রু গাড়িগুলো চলে না যাওয়া পর্যন্ত তোমাদের খুব সাবধানে ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করতে হবে। ওরা চলে গেলে রাস্তার পাশে কোন ঝোপে আশ্রয় নিয়ে তোমাদেরকে গাড়ি তালাশ করতে হবে।’
গাড়ি প্রবেশ করল টিলাপূর্ণ আঁকা-বাঁকা রাস্তায়। টিলাগুলো গাছ ও ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা।
ফুলস্পীডে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। সান ওয়াকারদের নামিয়ে দিতে যে সময় যাবে, তা এই ভাবে সঞ্চয় করতে চায় আহমদ মুসা।
আঁকা-বাঁকা রাস্তায় গাড়ির এই গতি দেখে ভয়ে শ্বাস রুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল মেরী রোজ ও সান ওয়াকারের।
গাড়িটা গভীর জংগলে একটা টিলার প্রান্তে উপত্যকার মুখে হার্ড ব্রেক কষে দাঁড়াল তারা যেন প্রাণ ফিরে পেল।
গাড়ি থামতেই আহমদ মুসা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির টিলার দিকের দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘দ্রুত নাম।’
দ্রুত নামল তারা দু’জন।
থেমেই মেরী রোজ বলল, ‘মাফ করবেন আপনি আহমদ মুসা নন কি?’
আহমদ মুসা চমকে উঠে তাকাল মেরী রোজ-এর দিকে। তারপর গাড়ির দরজা বন্ধ করে এবং সুইচ টিপে ছাদ দিয়ে গাড়ির উন্মুক্ত অংশ ঢেকে দিতে দিতে বলল, ‘সত্যি বলেছেন। ফটো দেখে চেনেন, না শুনেছেন কারও কাছে?’
‘শিলা সুসানের কাছে শুনেছি। সেও আজ আরেকটা গাড়িতে ওখানে আমার সাথে ছিল।’ বলল মেরী রোজ।
আহমদ মুসা গাড়িতে উঠার জন্যে ড্রাইভিং দরজা খুলে ফেলেছিল। মেরী রোজ-এর কথা শুনে সংগে সংগেই ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘সে ওখানে ছিল আপনার সাথে? তাহলে চিন্তা নেই, সে এদিকে আসবে। তোমরা তার অপেক্ষা কর।’
‘কেমন করে এ কথা বলছেন?’ মেরী রোজ বলল চোখ কপালে তুলে।
আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে দরজা বন্ধ করে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, ‘বাহামার হোয়াইট ঈগল-এর নেতা জর্জ ফার্ডিনান্ডের মেয়ে শিলা সুসানকে আমি জানি।’
গাড়ি চলতে শুরু করলে মুখ ফিরিয়ে চাপা কণ্ঠে বলল, ‘আবার এতক্ষণ তোমরা দাঁড়িয়ে আছ। যাও যা বলেছি তাই করবে।’
ঝড়ের গতি নিয়ে ছুটে চলে গেল আহমদ মুসার গাড়ি।
গভীর জংগলের দিকে ছুটতে ছুটতে মেরী রোজ বলল, ‘সত্যি মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে কোন আপনজন যেন আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’
‘ঠিক বলেছ রোজ। এমন মানুষ আমি দেখিনি যে মাত্র এক ঘন্টায় হৃদয়ে ঢুকে জয় করে নিতে পারে। এই আহমদ মুসা কে?’
‘চল, বলব। এটুকু জেনে রাখ, শত ক্যাস্ট্রো, শত চেগুয়েভারা এবং শত হোচিমিনকে জোড় দিলেও তার মত বিপ্লবী হবে না।’
ছুটছে তখন আহমদ মুসার গাড়ি।
অরলিংটন এলাকা পার হয়ে ভার্জিনিয়ার মধ্যে দিয়ে পশ্চিমমুখী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এগিয়ে চলছে আহমদ মুসা।
দক্ষিণমুখী আরেকটা এক্সপ্রেসওয়ে সে পেল। কিন্তু সড়কটি উন্মুক্ত সমভুমির মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। আহমদ মুসা ঝোপ-ঝাড় ও উঁচু-নিচু টিলার মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া পশ্চিমমুখী সড়ককেই পছন্দ করল।
পেছনের অনুসরণকারী গাড়ি যতখানি দূরত্বে ছিল তার বেশী এগুতে পারেনি। কিন্তু হেলিকপ্টার অনেকখানি কাছে চলে এসেছে। তবু এখনও ১৫ ডিগ্রি কৌণিক দূরত্বে রয়েছে। কিন্তু হেলিকপ্টার অন্তত ৪০ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থানে চলে এলে তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সরে পড়া কঠিন হবে।
আরও কিছুটা চলার পর হেলিকপ্টার আহমদ মুসার গাড়ি থেকে ২৫ ডিগ্রি কৌণিক দূরত্বে চলে এল। হেলিকপ্টারটি দ্রুত এগিয়ে আসছে। আহমদ মুসা গাড়ির সর্বোচ্চ স্পীড ব্যবহার করেও দূরত্ব বাড়াতে পারছে না কমছেই।
আহমদ মুসা ভাবল আর কিছুক্ষণের মধ্যে যদি সে সরে পড়ার কোন ব্যবস্থা না করতে পারে তাহলে হেলিকপ্টারের নজরে সে বাঁধা পড়ে যাবে।
কিন্তু কিভাবে সে সরে পড়বে?
গাড়ি নিয়ে পালানো যাচ্ছে না।
গাড়ি থেকে নেমে পালানো কঠিন হবে।
গাড়ি তখন একটা ব্রীজের মুখে এসে পড়েছে। ব্রীজ মানে নদী। নদীর কথা মনে হতেই নতুন প্রাণ পেল আহমদ মুসা। কোন নদী এটা? ভার্জিনিয়ার মানচিত্র যতটুকু স্মরণ আছে তাতে মনে হয় এটা পটোম্যাক নদী থেকে বেরিয়ে আসা সেনেনদোয়া বনাঞ্চলের সেনেনদোয়া নদী।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল আহমদ মুসা।
ব্রীজের মাঝখানে পৌঁছে গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির স্পীড অব্যাহত রেখেই গাড়ি থেকে নিজেকে ছিটকে দিল ব্রীজের উপর।
নূতন গাড়ি। তার স্টিয়ারিং হুইল আহমদ মুসাকে সহায়তা করল। গাড়িটি তীর বেগে সোজা এগিয়ে ব্রীজ পেরিয়ে রাস্তার এক পাশে গড়িয়ে পড়ে উল্টে গেল। দেখলেই মনে হবে আহমদ মুসা ব্রীজ পেরিয়ে টার্ন নিতে গিয়ে ঢালু রাস্তায় তীব্র গতির কারণে এ্যাকসিডেন্ট করেছে।
ওদিকে আহমদ মুসা ব্রীজে আছড়ে পড়ে আঘাত পেল তার আহত কপালটায় আবার।
তার দু’চোখে অন্ধকার নেমে এল। সে কি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছে?
না তাকে এখানে এই মুহূর্তে সংজ্ঞা হারালে চলবে না। পেছনের গাড়ি অল্পক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে এ ব্রীজে এবং হেলিকপ্টারও।
আহমদ মুসা জোর করে চোখ খোলা রেখে সর্বশক্তি দিয়ে অনুভূতিকে জাগ্রত রাখার চেষ্টা করে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল ব্রীজের রেলিং ধরে। তারপর আচ্ছন্ন অনুভূতির সাহায্যে আহমদ মুসা রেলিং পেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। কোথায় পড়ছে, তারপর কি হবে এসব দেখার-বুঝার কোন শক্তি তখন আহমদ মুসার নেই। তার আচ্ছন্ন অনুভূতিতে তখন একটা বিষয়ই ছিল তাকে নদীর পানিতে পড়তে হবে, নদীর স্রোত তাকে কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাবে।
এ্যাকসিডেন্টে পড়া আহমদ মুসার গাড়িকে প্রথম দেখতে পেল গোল্ড ওয়াটার। সে চোখে দূরবীন লাগিয়ে বসেছিল হেলিকপ্টারে। তার পাশেই বসে ছিল ইহুদী গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল শ্যারণ।
রাস্তার নিচে খাদে উল্টে পড়া আহমদ মুসার গাড়ির উপর চোখ পড়তেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে গোল্ড ওয়াটার বলল, ‘সর্বনাশ জেনারেল শ্যারণ, আহমদ মুসা এ্যাকসিডেন্ট করেছে। মারা গেল নাকি?’
জেনারেল শ্যারণ তার চোখের দূরবীণ সেদিকে ঘুরিয়ে উল্টে পড়া গাড়িটা দেখে বলল, ‘উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কেন মি: গোল্ড ওয়াটার। তার এবং তার খয়েরখাঁ মুসলিম দেশগুলোর উপর যে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম, তা না হওয়ায় ক্ষতি আমাদের হবে। কিন্তু ব্যাটা শেষ হলে আমরা বাঁচি। এটাও কম লাভ নয়।’
‘আপনার হিসাবে আপনি ঠিক আছেন জেনারেল। কিন্তু আমাদের হিসাব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
‘কোন হিসাব? তিন বিলিয়ন ডলারের? হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, সে প্রশ্নটা এখন উঠতেই পারে।’
‘কিন্তু জেনারেল, প্রশ্নটা আসলেই উঠতে পারে কি? তাকে তো আপনাদের হাতে দিয়েছি আমরা। সুতরাং বিনিময় তো হয়েই গেছে।’
‘তাই যদি হয়, তাহলে উদ্বিগ্ন কেন বলুন তো আপনার হিসাব নিয়ে? উদ্বেগের কারণ, আপনিও বোঝেন যে, তিন বিলিয়ন ডলারের প্রতি আপনার দাবী এখন খুবই দুর্বল।’
গোল্ড ওয়াটার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু হেলিকপ্টার তখন এ্যাকসিডেন্টে পড়া আহমদ মুসার গাড়ির পাশেই ল্যান্ড করেছে।
গোল্ড ওয়াটার ও জেনারেল শ্যারণ দ্রুত নেমে এল হেলিকপ্টার থেকে।
হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসা অন্যান্যরা ইতিমধ্যেই উল্টানো গাড়ি সোজা করেছে।
গাড়ির দিকে তাকিয়ে গোল্ড ওয়াটার এবং জেনারেল শ্যারণের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। গাড়িতে কেউ নেই।
কিছুক্ষণ তারা কথা বলতে পারল না।
কোথায় গেল জলজ্যান্ত তিনজন লোক? এ্যাকসিডেন্টের পর ওরা কি গাড়ি থেকে বেরিয়ে পালিয়েছে? এত অল্প সময়ে এটা কি সম্ভব? বলল গোল্ড ওয়াটার বিস্ময়ের সাথে, ‘এ্যাকসিডেন্ট হওয়ার দু’চার মিনিটের মধ্যেই স্পটটি আমার নজরে এসেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় এ্যাকসিডেন্ট থেকে বেঁচে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যাওয়া বাস্তব নয়।’
‘কিন্তু মি: গোল্ড ওয়াটার, তারা যখন গাড়িতে নেই, তখন পালিয়েছে এটাই বাস্তবতা।’ বলল জেনারেল শ্যারণ।
তিনটি গাড়িও এসে পৌঁছল এ সময়। গাড়ি থেকে নামল ওরা ১৪ জন।
‘পালিয়ে ওরা বেশিদূর যেতে পারেনি অবশ্যই, কথাগুলো স্বগোতোক্তির মত সকলের দিকে তাকিয়ে বলল গোল্ড ওয়াটার, তোমরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়। নদীর তীরটাও তোমরা দেখ। তিনজন লোক পালিয়ে বেশিদূর যেতে পারবে না।’
‘মি: গোল্ড ওয়াটার, ওরা এদিকে দেখুক। চলুন আমরা হেলিকপ্টারে যাই। লো-ফ্লাই করে সার্চ করাটা বেশি ফলপ্রসূ হবে।’ বলল জেনারেল শ্যারণ।
হেলিকপ্টারের দিকে চলল গোল্ড ওয়াটার এবং জেনারেল শ্যারণ।
হঠাৎ গোল্ড ওয়াটারের বাড়ির সামনে ছুটাছুটি দেখে রাস্তার পাশে গাড়ি নিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল শিলা সুসান।
সে দেখল ভীষণ উত্তেজিত ও ব্যস্তসমস্ত ডজনেরও বেশি লোক তিন গাড়ি বোঝাই হয়ে বাড়ির পাশের রোড ধরে ছুটল পশ্চিম দিকে।
ব্যাপারটা দেখে বিস্মিত হলো শিলা সুসান। ভাবল, কিছু একটা ঘটেছে।
আরও কিছুটা সময় পার হলো। বাড়ির দিক থেকে আর কেউ বের হলো না। হৈ চৈ কিছু শোনা গেল না।
বাড়ির দিকে এগুবে। ভাবল শিলা সুসান।
ঠিক এই সময় ব্যস্ত ও উত্তেজিত গোল্ড ওয়াটার আরও কয়েকজনকে নিয়ে প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে এল। বেরিয়েই ছুটল তারা বাড়ির পুব পাশের উন্মুক্ত লনে দাঁড়ানো হেলিকপ্টারের দিকে।
ওরা সবাই হেলিকপ্টারে উঠল এবং উঠার সাথে সাথেই হেলিকপ্টার উড়ল আকাশে।
শিলা সুসান এবার সত্যি সত্যি উদ্বেগ বোধ করল। কি ঘটেছে? কোথায় যাচ্ছে ওরা?
গেটে স্টেনগানধারী দারওয়ান দাঁড়িয়ে, দেখতে পাচ্ছে সে।
কৌতূহলকে দমিয়ে রাখতে পারলো না শিলা সুসান। ভাবল সে দারোয়ানকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে।
ভাবার সাথে সাথেই শিলা সুসান গাড়ি চালিয়ে গোল্ড ওয়াটারের গেটে গিয়ে দাঁড়াল।
গেটম্যান এগিয়ে এল শিলা সুসানের গাড়ির কাছে। তার হাতে স্টেনগান। বলল, ‘বলুন, কি সাহায্য করতে পারি ম্যাডাম।’
কথা আগেই গুছিয়ে রেখেছিল শিলা সুসান। বলল, ‘আমি গোল্ড ওয়াটার আংকেলের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
‘কে আপনি?’
‘শিলা সুসান। উনি আমার বাবার বন্ধু।’
গার্ড একটু চিন্তা করল। বলল, ‘একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। খুব ব্যস্ত ওরা আজ। উনিও বেরিয়ে গেছেন।’
‘কি ঘটেছে? কারও অসুখ-বিসুখ?’
‘না অসুখ-বিসুখ নয়। একজন আরেকজনকে সাথে নিয়ে পালিয়ে গেছে? তাদেরকে ধরার জন্যেই বেরিয়েছেন ওরা।’
পালাবার কথায় চমকে উঠল শিলা সুসান। কারা পালাল? আহমদ মুসা কি? জিজ্ঞেস করল গোবেচারা ঢংয়ে, ‘কাজের লোক পালিয়েছে কিছু চুরি করে?’
গেটম্যানের চোখে-মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। বলল, ‘কাজের লোক হবে কেন? তারা আর কি চুরি করবে? দু’জন দুষ্ট লোককে ধরে রাখা হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। তারাই পালিয়েছে।’
শিহরিত হলো দেহটা শিলা সুসানের। তাহলে আহমদ মুসা ও সান ওয়াকার পালিয়েছে, তারা যেমনটা ভেবেছিল। মনে আনন্দের একটা ঢেউ খেলে গেল।
কিন্তু গেটম্যানের সামনে মুখটা ভার করে বলল, ‘খুবই দুঃসংবাদ। আমি চলি।’
বলে শিলা সুসান গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে এল রাস্তায়। ছুটল সে মেরী রোজ-এর কাছে তাকে সুখবরটা জানানোর জন্যে।
কিন্তু মেরী রোজ যেখানে ছিল গাড়ি পার্ক করে, সেখানে পেল না তাকে।
শুধু বিস্মিত নয়, উদ্বিগ্নও হলো শিলা সুসান। মেরী রোজ অবশ্যই অন্য কোথাও যাবার কথা নয়। কোন বিপদে পড়েনি তো সে?
হঠাৎ তার মনে হলো, আহমদ মুসা ও সান ওয়াকার পালাবার সাথে তার অন্তর্ধানের কোন যোগ নেই তো? কিংবা হোয়াইট ঈগলের লোকরা মেরী রোজকে চিনতে পেরে তাদের সাথে নিয়ে যায়নি তো?
এই শেষ কথাটা ভাবার সাথে সাথে শিলা সুসানের বুকটা কেঁপে উঠল ভয়ে এবং সিদ্ধান্ত নিল ওদের অনুসরণ অবশ্যই করতে হবে তাকে।
সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি স্টার্ট দিল শিলা সুসান। ঝড়ের বেগে গাড়ি এগিয়ে চলল।
৩
সেনেনদোয়া নদী দিয়ে এগিয়ে চলছিল সুন্দর একটি মোটর বোট।
সেনেনদোয়া নদীটি উত্তর বাহী। …. পর্বতমালা থেকে বেরিয়ে গ্রেটভ্যালি হয়ে সেনেনদোয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাশ ঘেঁষে উত্তরে এগিয়ে চলেছে পটোম্যাক নদীতে।
মাঝারী স্পীডে চললেও স্রোতের বিপরীতে চলছে বলে বেশ শব্দ করে পানি কাটছে বোটটি।
বিলাসবহুল ট্যুরিস্ট বোট।
বোটের দোতলার কেবিনে ইজি চেয়ারে বসে আছে ষাটোর্ধ বয়সের প্রফেসর আরাপাহো আরিকারা। ইলিয়া রাজ্যের মিসিসিপি তীরের প্রাচীন রেড ইন্ডিয়ান নগরী ‘কাহোকিয়া’র ‘রেড ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ’ (RIHR)- এর চেয়ারম্যান তিনি। তিনি একজন সম্মানিত রেড ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী।
ছুটির সুযোগে তিনি বেড়াতে বেরিয়েছেন।
তার এক ছেলে ও এক মেয়ে দু’জনেই জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্টবিজ্ঞানের ছাত্র।
তার এই সফরে দুই ছেলেমেয়েও তার সাথী।
নৌ-পথে ভ্রমণের মজার প্ল্যান নিয়ে বেরিয়েছে তারা।
তারা ওয়াশিংটন নগরীর উপকণ্ঠ থেকে ট্যুরিস্ট মটর বোট নিয়ে যাত্রা করেছে। পটোম্যাক থেকে তারা পড়েছে সেনেনদোয়া নদীতে। এ নদী থেকে তারা উঠবে এক্সপ্রেস ওয়েতে। তারপর পশ্চিম ভার্জিনিয়ার চার্লসটন হয়ে তারা যাবে হান্টিংটনে। এখান থেকে ওহাইও নদী পথে তাদের নৌযাত্রা শুরু হবে আবার। ওহাইও হয়ে মিসিসিপি দিয়ে তারা পৌঁছবে কাহোকিয়া।
ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে প্রফেসর আরাপাহো আরিকারা চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে।
তার ছেলে জিভারো ডেক চেয়ারে বসে মাঝে মাঝে চারদিকে দেখছিল, আবার একটা উপন্যাসে চোখ বুলাচ্ছিল এবং মেয়ে হায়েদা ওগলালা উপরে কেবিনের ছাদে, ছাদ সমান বিশাল ফোম ম্যাটে গড়াগড়ি দিচ্ছে। জিভারো এবং ওগলালা দু’জনেরই উদ্দেশ্য শরীরে কিছুক্ষণ সূর্য্যের তাপ নেয়া।
কেবিনের ছাদে বড়ো কোন আঘাত বা ভারি কিছু পড়ার শব্দ হলো। সেই সাথে ওগলালার চিৎকার।
প্রফেসর আরাপাহো আরিকারা নদী তীরের দৃশ্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। তার মনে পড়ছিল, এই উপত্যকা বনাঞ্চলে একদিন রেড ইন্ডিয়ানদের শক্তিশালী সাম্রাজ ছিল। যার কেন্দ্র ছিল মিসিসিপি কেন্দ্রিক সমভূমি অঞ্চল। এই বিশাল অঞ্চলে মোহক নেতা রেড ইন্ডিয়ান বীর হাইওয়াথার নেতৃত্বে ইরিকুইস ইন্ডিয়ানদের শক্তিশালী শাসন গড়ে উঠেছিল। এই রকম নদীগুলোর দু’তীরে এবং বনাঞ্চলে শিকার সন্ধানী রেড ইন্ডিয়ানদের ছিল গৌরবপূর্ণ বিচরণ। প্রফেসর আরাপাহো আরিকারা যেন দেখতে পাচ্ছে সেদিনের তাদেরকে।
মাথার উপরে প্রচণ্ড শব্দ এবং ওগলালার চিৎকারে তার সম্বিত ফিরে এল। সোজা হয়ে বসল সে। বলল হাঁক দিয়ে ছেলেকে লক্ষ্য করে, ‘কি হয়েছে জিভারো?’
বলে নিজেই বেরিয়ে এল কেবিন থেকে ডেকে।
ততক্ষণে জিভারো সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে উঠে গেছে কেবিনের ছাদে।
প্রফেসর আরাপাহো আরিকারাও সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠল। বয়স তার ষাটোর্ধ হলেও দেখতে চল্লিশের বেশি মনে হয় না।
প্রফেসর আরাপাহো আরিকারা ছাদের উপর নজর পড়তেই দেখল, একজন যুবক পড়ে আছে ছাদের ফোম ম্যাটের উপর। তার কপালে ক্ষত। রক্ত বেরুচ্ছে সেখান থেকে।
ওগলালা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই।
জিভারো ঝুঁকে পড়ে যুবকটিকে পরীক্ষা করছিল।
প্রফেসর আরাপাহো ছাদে উঠতেই জিভারো বলল, ‘আব্বা, লোকটা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে।’
মোটর বোট তখন ব্রীজ থেকে বেশ একটু দক্ষিণে সরে এসেছে।
প্রফেসর আরাপাহো তাকাল ব্রীজের দিকে। কোন মানুষ, কোন গাড়ি কিছুই দেখতে পেল না। যুবকটি কি নিজেই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল? না কেউ তাকে ফেলে দিয়েছিল?
এসব চিন্তা রেখে যুবকটির দিকে তাকিয়ে প্রফেসর আরাপাহো বলল, ‘যুবকটি এশিয়ান। এবং কপালের আঘাতটি তার বোটে পড়ার ফলে নয়। একে নিচে নিয়ে চল জিভারো।’
‘ঠিক বলেছেন আব্বা। ওর পেছনটা আগে পড়েছে। এখানে কপালে সে আঘাত পায়নি।’ বলল হায়েদা ওগলালা।
বলে ওগলালা একটু থামল দম নেবার মত। তারপর বলল, ‘অল্পের জন্যে আমি বেঁচে গেছি। আমার একদম মাথার কাছেই ও এসে পড়েছে।’
বাপ, বেটা, বেটি তিনজনেই ধরাধরি করে নামাল যুবকটিকে নিচে দু’তলার ডেকে।
নিচ থেকে বোটের একজন স্টাফ এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রফেসর আরাপাহো তাকে তাড়াতাড়ি ফাস্ট এইড বক্স আনতে বলল নিচ থেকে।
ফার্স্ট এইড বক্স আনলে প্রফেসর আরাপাহো বক্স থেকে স্পিরিটের শিশি তুলে নিয়ে বলল, ‘এর সংজ্ঞা আগে ফেরানো দরকার।’
বলে সে স্পিরিটে তুলা ভিজিয়ে যুবকটির নাকে ধরে রাখল।
যুবকটি আহমদ মুসা।
প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেই সে লাফিয়ে পড়েছিল ব্রীজ থেকে। আল্লাহর করুনা সে পানিতে পড়েনি, আবার বোটের নরম ম্যাট তাকে বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। কিন্তু বোটে পড়ার পর পুরোপুরি সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে।
স্পিরিটের উদ্দীপক গন্ধে তাড়াতাড়ি সংজ্ঞা ফিরে পেল আহমদ মুসা। চোখ মেলল সে।
প্রথমেই চোখ বুজে গেল আহমদ মুসার। মনে পড়লো তার, সে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার গা ভিজা নয়। তাহলে কি এই বোটের উপর পড়েছিল? এবং সে সংজ্ঞা হারিয়েছিল? কতক্ষণ সময় গেছে? হোয়াইট ঈগলের লোকেরা কোথায়? এরা কারা? চেহারায় এরা রেড ইন্ডিয়ান। কিন্তু পোশাকে ইউরোপিয়ান। তাহলে শিক্ষিত ও শহুরে রেড ইন্ডিয়ান এরা।
আবার চোখ খুলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা চোখ খুললে জিভারো আহমদ মুসার ঘাড়ের নিচে হাত দিয়ে তার মাথা উঁচু করে তুলে ধরল। আর প্রফেসর আরাপাহো এক গ্লাস ব্রান্ডি আহমদ মুসার মুখের কাছে তুলে ধরে বলল, ‘খেয়ে নাও। শরীরটা সবল হবে। ভাল লাগবে তোমার।’
‘গ্লাসে নিশ্চয় ব্রান্ডি অথবা বিয়ার? আমি মদ খাই না।’ বলল আহমদ মুসা।
বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল প্রফেসর আরাপাহো এবং জিভারো ও ওগলালার চোখে-মুখে।
‘অল রাইট ইয়ংম্যান। এখন কেমন মনে করছ?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘ভালো জনাব।’ বলে উঠে বসল আহমদ মুসা।
‘বসে থাকতে পারবে? না শুয়ে পড়বে? আহত স্থান থেকে এখনও রক্ত বেরুচ্ছে। তাড়াতাড়ি ড্রেসিং করে দিতে হবে।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
আহমদ মুসা প্রফেসর আরাপাহোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জনাব আপনি কষ্ট করবেন? একটু পর আমিই সব কিছু ঠিক করে নিতে পারব।’
‘তোমার সৌজন্য বোধের জন্যে ধন্যবাদ।’ বলে প্রফেসর আরাপাহো কাজে লেগে গেল।
ড্রেসিং করতে করতে বলল, ‘খারাপ হবে না আমার ড্রেসিং। ভাল ট্রেনিং আছে এ ব্যাপারে আমার।’
ড্রেসিং শেষে আহমদ মুসাকে নিয়ে এল কেবিনে।
আহমদ মুসা নিজেই হেঁটে এল এবং কেবিনের টয়লেটে গিয়ে তার মুখ পরিষ্কার করল। জিভারো এবং ওগলালা পাশে দাঁড়িয়েছিল। জিভারো সাহায্য করতে চাইলে আহমদ মুসা বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাদের, যেটুকু পারা যায় নিজে করাই ভাল।’
কেবিনের টেবিলে বসল সবাই। পরিবেশিত হলো গরম চা।
প্রফেসর আরাপাহো চায়ের কাপ তুলে নিতে নিতে বলল, ‘ইয়ংম্যান, অবশ্যই চাযে তোমার অভ্যেস আছে? নাও।’
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলে চা তুলে নিল আহমদ মুসা।
জিভারো এবং ওগলালাও চায়ে চুমুক দিল।
চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে প্রফেসর আরাপাহো বলল, ‘ইয়ংম্যান, তোমার কপালের আহত স্থানে দু’বার আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। একটা কয়েক ঘণ্টা আগের, আরেকটা তাজা। সত্যি কি তাই?’
‘জ্বি, ঠিক বলেছেন।’
‘তোমার নাম কিন্তু এখনও আমরা জানি না। তুমি কি মুসলিম?’
‘জ্বি। কি করে বুঝলেন?’
‘প্রথমত, তোমার কপালে নামাযের চিহ্ন দেখেছি। দ্বিতীয়ত, তুমি মদ খাও না।’
‘জনাব, নাম জিজ্ঞেস করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই আমি ঠিক নামটা বলতে পারি না।’
‘বুঝেছি। দেখ, আমি কাহোকিয়ার ‘রেড ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ’- এর চেয়ারম্যান। এরা আমার ছেলেমেয়ে। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।’
আহমদ মুসা ওদের দু’জনের দিকে তাকাল। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনে মনে পড়ল সান ওয়াকার, মেরী রোজ ও শিলা সুসানের কথা। বলল ওদের লক্ষ্য করে, ‘তোমরা কি ঈগল সান ওয়াকারকে চেন?’
সান ওয়াকারের নাম শুনেই দু’জনের চোখ-মুখ যেন নতুন করে জেগে উঠল। তার সাথে কিছুটা মলিন হয়ে উঠল ওগলালার মুখ। একটা বেদনার প্রকাশ সেখানে স্পষ্ট।
ওগলালাই জিজ্ঞেস করল, ‘চিনেন আপনি তাকে?’ কণ্ঠ তার অনেকটা শুকনো।
‘চিনতাম না। তবে একই বন্দীখানায় থাকার সময় তাকে চিনেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘একই বন্দীখানায়? আমরা শুনেছি সে তো হোয়াইট ঈগলের হাতে বন্দী।’
‘আমিও বন্দী ছিলাম হোয়াইট ঈগলের হাতে।’
প্রচণ্ড এক বিস্ময় নেমে এল ওগলালা, জিভারো এবং প্রফেসর আরাপাহোর চোখে-মুখে।
কিছুক্ষণ যেন তারা কিছুই বলতে পারল না।
‘হোয়াইট ঈগল তোমাকে বন্দী করল কেন? শুধু অশ্বেতাংগ বলে নিশ্চয় নয়?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো নীরবতা ভেঙে।
‘ঠিক বলেছেন জনাব। আমি ক্যারিবিয়ান দ্বীপাঞ্চলে অশ্বেতাংগ বিশেষ করে মুসলমানদের পক্ষ নিয়েছিলাম, এটাই আসল কারণ। আমার কারণে নাকি ক্যারিবিয়ান অঞ্চলকে শ্বেতাংগকরণের ওদের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, আমাকে বিক্রি করে ওরা বিলিয়ন ডলার উপার্জন করতে চেয়েছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
জিভারো, ওগলাল এবং প্রফেসর আরাপাহোর স্থির দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখে নিবদ্ধ। তাদের চোখে বিস্ময় ও কিছুটা সমীহের ভাব।
আহমদ মুসা থামলে সংগে সংগেই প্রফেসর আরাপাহো বলে উঠল, ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড টিভি এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি ক্যারিবিয়ানে ওদের অশ্বেতাংগ বিরোধী ষড়যন্ত্রের কথা। তাহলে তুমিই এসব করিয়েছ বলছ?’
‘আমি কৃতিত্ব দাবী করছি না। ওদের সাথে আমার শত্রুতার কারণ বলেছি।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রফেসর আরাপাহো হাসল। বলল, ‘তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। আমার কথার ঐ রকম অর্থ হওয়ার জন্যে আমরা দুঃখিত।’
বলে একটু থামল প্রফেসর আরাপাহো। থেমেই আবার বলল, ‘হোয়াইট ঈগল তোমাকে বিক্রি করার অর্থ বুঝলাম না।’
‘হ্যাঁ, ওরা আমাকে ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার কাছে কয়েক বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করতে যাচ্ছিল।’ আহমদ মুসা বলল।
প্রফেসর আরাপাহোসহ ওদের তিনজনেরই ভ্রু কুঞ্চিত হলো টাকার অংক শুনে। বলল প্রফেসর আরাপাহো, ‘ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার লাভ?’
‘ওদের সাথে আমার পুরানো শত্রুতা। ইসরাইলে ওদের পতন নাকি আমার কারণে। ওরা প্রতিশোধ নিতে চায় এবং আমাকে হাতে রেখে কয়েকটি মুসলিম সরকারের সাথে দর কষাকষি করতে চায়।’
প্রফেসর আরাপাহোর বিস্ময় বিজড়িত মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘তুমি নিরাপত্তার কারণেই তোমার নাম বলনি। কিন্তু তুমি সাংঘাতিক একটা অস্ত্র তুলে দিলে আমাদের হাতে। ঐ লাভজনক ব্যবসায়ের উদ্যোগ হোয়াইট ঈগলের মত আমরাও নিতে পারি।’
‘আমি নিশ্চিত হবার পরই একথা বলেছি জনাব। কাহোকিয়ার রেড ইন্ডিয়ান সংস্থার কেউ এই ব্যবসা করতে যাবে না।’
‘তুমি কাহোকিয়াকে জান?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘কিছু কিছু শুনেছি। সান ওয়াকারও কাহোকিয়া এবং আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টের লোক।’
গম্ভীর হলো প্রফেসর আরাপাহোর মুখ। বলল, ‘তুমি আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টের বিষয়ে জান?’
‘কিছু কিছু।’
‘ইয়ংম্যান, আমার মনে হচ্ছে তুমি যথার্থ ভাবেই নাম বলায় সতর্কতা অবলম্বন করেছ। প্রয়োজন হলে নামটা তোমার বলো। আপাতত আমি তোমাকে আহমদ মুসা বলেই ডাকব। এখন বলল, কেমন করে বন্দীখানা থেকে এই সেনেনদোয়া নদীর ব্রীজে এলে?’
প্রফেসর আরাপাহোর মুখে আহমদ মুসার নাম শুনে বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে গেল আহমদ মুসা। বলল, ‘আহমদ মুসাকে আপনি চেনেন?’
‘চিনি না জানি। এবং জানি শুধু নয়, আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টের সকলেই জানে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা তাদের জীবন্ত মডেল।’
‘ঠিক আছে ঐ নামটায় দিন। কিন্তু নামটা বাইরে দয়া করে বলবেন না। সীমাবদ্ধ রাখবেন আপনাদের তিনজনের মধ্যে।’
প্রফেসর আরাপাহো এবং ওগলালা ও জিভারো কারোরই বুঝতে বাকি রইল না যে, তাদের সামনের যুবকটিই আহমদ মুসা। তাদের তিনজনের বিস্ময় দৃষ্টি গিয়ে আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
নীরবতা ভাঙল প্রফেসর আরাপাহো। বলল, ‘আমি খুশী যে আমি ঠিক মানুষকে ঠিক নাম দিয়েছি। আর ঈশ্বরের প্রশংসা করছি যে, তিনি আপনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এনেছেন এবং আপনার সাথে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ দিয়েছেন। অধিকার বঞ্চিত রেড ইন্ডিয়ানরা খুশী হবে আপনার আগমনের এ খবরে।’
প্রফেসর আরাপাহোর মুখে এখন ‘আপনি’ সম্বোধনে বিব্রত বোধ করল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমি আপনার ছেলের বয়সের। আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করলেই আমি খুশী হবো।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু বয়সে ছেলের মত হলেও ওজন কিন্তু দাদার বয়সের। এ সম্মান তোমাকে না দিয়ে আমরা পারি না।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘আপনার মত মুরুব্বীদের স্নেহ আমার জন্যে বড় সম্মান।’ আহমদ মুসা বলল।
‘এখন বল সেনেনদোয়া ব্রীজে তোমার আসা এবং তোমার নদীতে পড়ার কাহিনী। আর সান ওয়াকারের খবর কি?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
আহমদ মুসা তার বন্দী হওয়া, বন্দী অবস্থায় গোল্ড ওয়াটারের ক্লোজ সার্কিট টিভি মনিটরে সান ওয়াকারকে দেখা ও তার পরিচয় পাওয়া, বন্দীখানা থেকে মুক্ত হওয়া এবং সান ওয়াকারকে মুক্ত করা, তাকে নিয়ে বন্দীখানা থেকে বের হওয়া, একটা গাড়ি হাইজ্যাক করে পলায়ন, মেরী রোজ-এর সাথে পরিচয় হওয়া, স্থল ও আকাশ পথে ঘেরাও হয়ে পড়ার পর মেরী রোজ ও সান ওয়াকারকে পালাবার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে তাদেরকে নিরাপদ স্থানে নামিয়ে দিয়ে ওদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেবার জন্যে গাড়ি নিয়ে অগ্রসর হওয়া এবং সবশেষে চলন্ত গাড়ি থেকে ব্রীজে লাফিয়ে পড়তে গিয়ে কপালে আবার আঘাত পাওয়া এবং বাঁচার জন্যে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া ইত্যাদি সব কথা সংক্ষেপে বর্ণনা করল তাদের কাছে।
সম্মোহিতের মত তারা শুনল সব কথা। বিস্ময় ও প্রশংসার প্রশ্রবণ তাদের চোখে মুখে।
আহমদ মুসা থামতেই ওগলালা বলল, ‘সান ওয়াকার অসুস্থ। সে পালাতে পারবে?’ ওগলালার কণ্ঠে উদ্বেগ ঝরে পড়ল।
‘পারবে। সাথে মেরী রোজ আছে। এবং আমার ধারণা শিলা সুসানও তাদের খোঁজে আসছে।’
‘তার কি ওয়াশিংটনে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে?’ ওগলালা বলল।
‘আমি মনে করি, ঠিক হবে না।’
‘কিন্তু মেরী রোজরা তাকে ওয়াশিংটনেই ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করবে?’
আহমদ মুসা ওগলালার কথার মধ্যে সান ওয়াকারের প্রতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনুরাগ এবং মেরী রোজ-এর প্রতি বিরাগ লক্ষ্য করল। এটা কি সান ওয়াকারের সাথে তার কোন বিশেষ সম্পর্কের ইংগিত দেয়? না এটা রেড ইন্ডিয়ান সান ওয়াকার, আর শ্বেতাংগ মেরী রোজ-এর প্রতি তার স্বাভাবিক মনোভারের প্রকাশ? কোনটা ঠিক বুঝতে পারল না আহমদ মুসা।
বলল আহমদ মুসা, ‘আমার মনে হয় তারা নিরাপত্তার দিকটা ভেবেই সিদ্ধান্ত নেবে।’
‘আপনি’ সেনেনদোয়ার ব্রীজে গাড়ি থামিয়ে না নেমে লাফিয়ে পড়তে গেলেন কেন?’ বলল জিভারো।
‘ওরা আমাকে তিনটি গাড়ি ও হেলিকপ্টার নিয়ে তাড়া করছিল, বুঝতে পারছিলাম, গাড়ি চালিয়ে বা গাড়ি থেমে নেমে ছুটে পালিয়ে ওদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে না। এই সময় পেয়ে গেলাম ব্রীজ। সিদ্ধান্ত নিলাম নদী দিয়ে পালাব। কিন্তু এই পালানো নিরাপদ করতে হলে ওদের বুঝতে দেয়া যাবে না যে আমি নদী দিয়ে পালিয়েছি। তা করতে হলে গাড়ি ব্রীজের উপর রাখা যাবে না, গাড়ি পাঠাতে হবে ব্রীজের ওপারে। ড্রাইভার বিহীন চলন্ত গাড়ি নিশ্চয় ওপারে গিয়ে এ্যাকসিডেন্ট করবে। ওরা বুঝবে এ্যাকসিডেন্ট করেছি, তারপর পালিয়ে গেছি। সে জন্যেই গাড়ি স্পীডে রেখে গাড়ি থেকে ব্রীজে লাফিয়ে পড়েছি। এ কৌশল কাজ দিয়েছে। সম্ভবত নদীর দিকে কেউ ওরা আসেনি। ওদের হেলিকপ্টার স্থলাঞ্চল ঘুরে বেড়াচ্ছে, নদীর উপর একবারও আসেনি।’
‘সাংঘাতিক উপস্থিত বুদ্ধি আপনার।’ বলল জিভারো।
‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি কোন রোমাঞ্চ কাহিনী পড়ছি। আপনি যদি আপনার কাহিনী লিখতেন দারুণ বিক্রি হতো।’ ওগলালা বলল।
চা’র পর নাস্তাও খেল তারা ঐ টেবিলে বসেই।
বেশ অনেকক্ষণ থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেনি প্রফেসর আরাপাহো। ভাবছিল সে। একসময় বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে, ‘ঈগল সান ওয়াকার রেড ইন্ডয়ানদের সমকালিন শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। আমি ভাবছি, এ প্রতিভার কি হবে? সেতো এখন কোথাও নিরাপদ নয়।’
আহমদ মুসা মুখ খোলার আগেই ওগলালা বলে উঠল, ‘আব্বা তার এ বিপর্যয়ের কারণ মেরী রোজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই বলাবলি করছে, মেরী রোজ সান ওয়াকারের ঘনিষ্ঠ হওয়াকে বর্ণবাদীরা মেনে নেয়নি। মেরী রোজ থেকে সান ওয়াকারকে বিচ্ছিন্ন করে বিদেশে কোথাও পাঠিয়ে দেবার জন্যেই হোয়াইট ঈগল সান ওয়াকারকে কিডন্যাপ করেছে। বলাবলি হচ্ছে, সান ওয়াকার যদি মেরী রোজ-এর সাথে সম্পর্ক না রাখে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনও সময় আর ফিরে আসতে চেষ্টা না করে, তাহলে সান ওয়াকারকে তারা পৃথিবীর কোনও দেশে পাঠিয়ে দেবে।’ ওগলালা থামল। তার কণ্ঠে ক্ষোভ ও অভিমান ঝড়ে পড়ল। সেই সাথে অব্যক্ত এক আবেগে লাল হয়ে উঠেছে তার মুখ।
‘আমি সান ওয়াকারকে জানি। সে এসব শর্তের কোনটাই মানবে না। জীবনের বিনিময়েও নয়। সুতরাং তার অবস্থা বিপজ্জনক, সে কথাই আমি ভাবছি।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘বর্ণবাদীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ শ্বেতাংগীনি মেরী রোজকে সান ওয়াকারের দিকে ঠেলে দেয়, সান ওয়াকারকে দিয়ে তাকে হিপনোটাইজ করে তারা এই সর্বনাশ……..।’
কান্নায় অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাসে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। কথা শেষ করতে পারলো না ওগলালা।
রুমালে মুখ চাপা দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, ‘সান ওয়াকারকে সে দু’চোখে দেখতে পারতো না, কত অপমান ও লাঞ্ছনা যে সান ওয়াকারকে করেছে। তারপর হঠাৎ তার রাতারাতি পরিবর্তন হওয়া একটা ষড়যন্ত্র।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলে সে ছুটে পালাল।
মুহূর্তকাল নীরবতা।
নীরবতা ভেঙে প্রফেসর আরাপাহো বলল, ‘কিছু মনে করো না আহমদ মুসা। ও খুব ইমোশনাল এবং জেদী। কিন্তু আবার ঠান্ডা হতেও দেরী হয় না।’
‘বুঝতে পেরেছি। কিন্তু একটা জিনিস আমি বলতে পারি। সান ওয়াকারকে কিডন্যাপ যে কারণেই করুক। কিন্তু এখন তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্টে-এর কাহোকিয়া সম্মেলনে তার ভূমিকা।’
‘সে তো ছাত্র মাত্র। কোন কর্মকর্তা সে তো নয়, মুভমেন্টের!’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘সম্মেলনের দাবী-নামা নাকি তার ড্রাফটিং।’
‘হোয়াইট ঈগল এটাও জানতে পেরেছে?’ প্রফেসর আরাপাহো বলল।
‘তারা সান ওয়াকারের কাছে জানার চেষ্টা করছিল ‘এইম’ (AIM-আমেরিকান ইন্ডিয়ান মুভমেন্ট)- এর সেন্ট্রাল কমিটির নবনির্বাচিত সদস্যদের নাম।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সান ওয়াকারতো এসব বলে দেয়ার মত ছেলে নয়। প্রফেসর আরাপাহো বলল।
‘সুতরাং সান ওয়াকারের ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ইতিমধ্যেই তার উপর দৈহিক নির্যাতন চালানো হয় অনেক। সে হয়তো বাঁচতো না ওদের হাত থেকে।’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। তোমাকেও ধন্যবাদ। সে বেঁচে গেছে।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘হ্যাঁ, এ যাত্রা বেঁচে গেছে।’
‘ঠিক বলেছ, তার বিপদ সামনে আরও আছে। খুবই দুঃসংবাদ এটা আমাদের জন্যে।’ প্রফেসর আরাপাহো বলল।
পরদিন সকাল।
বোট এসে ভিড়েছে স্ট্যানটনের কিছু উত্তর-পূর্বে ক্ষুদ্র নদীবন্দর ‘পোর্ট ভ্যালিতে।’
বন্দরটি সেনেনদোয়া নদী এবং গ্রেট ভ্যালি এক্সপ্রেসওয়ের একটা সংযোগ স্থল। পরিকল্পনা অনুসারে প্রফেসর আরাপাহোরা এখানে নামবে এবং সড়ক পথে যাবে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার চার্লসটন হয়ে হান্টিংটনে। হান্টিংটন ওহাইও নদীর একটা নৌবন্দর। এই নদী বন্দর থেকে প্রফেসর আরাপাহোরা যাবে ওহাইও ও মিসিসিপি হয়ে কাহোকিয়া।
আহমদ মুসা শুয়ে ছিল তার বেড়ে।
প্রফেসর আরাপাহো এসে ঢুকল আহমদ মুসার কেবিনে।
প্রফেসর আরাপাহোকে দেখে আহমদ মুসা উঠে বসতে যাচ্ছিল।
প্রফেসর আরাপাহো তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘না উঠো না, তুমি অসুস্থ।’
বলে প্রফেসর আরাপাহো বসল কক্ষের একটা চেয়ারে। বলল, ‘তুমি নাকি বলেছ এখানে নেমে তুমি চলে যেতে চাও?’
‘জ্বি, বলেছে।’
‘অসম্ভব। তোমার ভীষণ জ্বর। তোমাকে এভাবে আমরা ছাড়তে পারি না। তাছাড়া তোমাকে আমি কাহোকিয়াতে নিতে চাই।’
‘আমি ক্যারিবিয়ানের খোঁজ-খবর নিতে চাই। তাছাড়া সান ওয়াকাররা কোথায়, সেটাও দেখতে চাই।’
‘সব হবে। কিন্তু আগে তোমাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে এবং সেই সাথে তোমাকে কাহোকিয়াতেও যেতে হবে।’
বলে আহমদ মুসাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাকাল পেছনে।
পিতার সাথে সাথে ওগলালাও এসে প্রবেশ করেছিল ঘরে। তাকে লক্ষ্য করে প্রফেসর আরাপাহো বলল, ‘এ্যাম্বুলেন্স ওয়াগন কার’ পাওয়া গেছে মা?’
‘জ্বি, আব্বা। স্ট্যানটন থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে পৌঁছবে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা যাত্রা করতে পারব।’
‘ধন্যবাদ মা, সুন্দর এ্যারেঞ্জমেন্ট করেছ। এখন তুমি আহমদ মুসার ঔষধ ও কাপড় প্যাক করে এস ওদিকে।’
বলে বেরিয়ে গেল প্রফেসর আরাপাহো।
ঔষধ প্যাক করতে করতে ওগলালা বলল, ‘জনাব, আপনাদের সমাজে মেয়েরা নাকি আপাদ-মস্তক কাপড়ে প্যাক করে রাস্তায় বের হয়?’
ওগলালার কথার ঢংয়ে আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আপাদ-মস্তক কাপড়ে প্যাক করে নয়, সৌন্দর্যের স্থানগুলো ঢেকে বের হতে হয়।’
‘কেন?’
‘খারাপ দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে।’
‘এভাবে আগাম খারাপ ধারণা করে নেয়া কি ঠিক? খারাপ ঘটলে তবেই না তাকে খারাপ বলা যায়।’
‘মেয়েদের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং আকৃষ্ট হবার পর খারাপ চিন্তার উদয় হওয়া মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি। সুতরাং এ ব্যাপারে আগাম চিন্তা করা যায়।’
‘প্রবৃত্তিটা যদি সহজাত হয়, তাহলে তো এ থেকে আপনি, আমি, শিক্ষক, ছাত্র কেউই মুক্ত নয়। তাই কি?’
‘হ্যাঁ তাই।’
‘কিন্তু এটা কি বাস্তবতা?’
‘শিক্ষক-ছাত্রী কিংবা শিক্ষিকা-ছাত্রের মধ্যে অঘটন বা ঘটনা কি নেই?’
ওগলালা একটু চিন্তা করে বলল, ‘আছে।’
‘এটা কি বাস্তবতার প্রমাণ নয়?’
‘সবক্ষেত্রেই কিছু ব্যতিক্রম থাকে। ব্যতিক্রমের উপর কিন্তু কোন সাধারণ সিদ্ধান্ত হয় না।’
‘এ দু’চারটা ঘটনা আসলে ঘটনার আইস বার্গ। দেখুন, সব খারাপ চিন্তা খারাপ ঘটনায় রূপ নেয় না। আবার সব খারাপ ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ পায় না। সুতরাং সব মিলিয়ে ব্যতিক্রম যাকে বলছেন, তা ব্যতিক্রম নয়।’
‘তার অর্থ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে প্রবৃত্তিগতভাবে খারাপ প্রবণতা আছে এবং সেই অর্থে ধরে নিতে হবে প্রত্যেক মানুষই খারাপ।’
‘কথাটা এইভাবে বলা ভাল, প্রত্যেক মানুষ খারাপ, আবার প্রত্যেক মানুষই ভাল। আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনে স্রষ্টা বলেছেন, মানুষকে সুন্দরতর বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, আবার তাকে নিচ থেকে নীচত্বর করা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব ও পশুত্ব পাশাপাশিই বাস করে।’
‘মেয়েরা তাদের সৌন্দর্য ঢেকে বের হওয়াই কি ঐ পশুত্বের আক্রমণ থেকে বাঁচার উপায়?’
‘কথাটা এইভাবে বলুন, মেয়েরা জনসমক্ষে তাদের সৌন্দর্য ঢেকে রাখা মানুষের পশুত্বকে উস্কে না দেবার উপায়।’
‘আপনি সুন্দর করে কথা বলেন। ঠিক মনোযোগী প্রফেসরের মত। যাক, আপনাদের মেয়েদের সৌন্দর্য ঢেকে বেরুনোর যুক্তি পেলাম। এখন বলুন, আমাদের সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন?’
‘আমি বাইরের সংস্কৃতির লোক। ভাববেন তো আপনারা।’
‘ঠিকই বলেছেন। তবে ভাববার এ বিষয়টা কোনদিন কেউ এমনভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি। ধন্যবাদ আপনাকে।’
বলে একটু থেমেই আবার বলল, ‘মিঃ আহমদ মুসা, সান ওয়াকার অনেকটা আপনার মতই ভাবে। সে হিটলারের মত মেয়েদেরকে রান্নাঘরে ফিরিয়ে দেয়ার পক্ষপাতি।’
বলতে গিয়ে ওগলালার মুখ হঠাৎ মলিন হয়ে গেল।
থামল সে আবার। থেমেই আবার অনেকটা স্বগোতোক্তির মত বলল, ‘সেই ভাল, অতি সরল সান ওয়াকার কিনা শ্বেতাংগদের ফাঁদে গিয়ে পড়ল।’
বলেই তাড়াতাড়ি দু’হাতে মুখ ঢেকে ছুটে বেরিয়ে গেল ওগলালা।
আহমদ মুসা খুব বিস্মিত হলো না। আগেই সে বুঝতে পেরেছিল ওগলালা ভালোবাসে সান ওয়াকারকে। আর সে মনে করে মেরী রোজ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সান ওয়াকারকে ভালোবাসার ফাঁদে আটকেছে। সে জন্যে ওগলালা ভীষণ ক্রুদ্ধ মেরী রোজ-এর উপর। এ বিষয়টা আজ আরও পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে এবং বুঝল যে, সান ওয়াকারের প্রতি ওগলালার ভালোবাসা সাংঘাতিকভাবে অন্ধ। এই বুঝতে পারা শংকিত করল আহমদ মুসাকে। বেচারা মেরী রোজ ওগলালার হিংসার শিকার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ আহমদ মুসা যতটুকু দেখেছে, সান ওয়াকারের প্রতি মেরী রোজ-এর ভালোবাসা নিখাদ। সান ওয়াকারের জন্যে মেরী রোজ-এর চোখে যে উদ্বেগ ও ব্যাকুলতা সে দেখেছে তাতে কোন কৃত্রিমতা নেই।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই প্রফেসর আরাপাহো যাত্রা করল এ্যাম্বুলেন্স ওয়াগনে করে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার চার্লসন হয়ে ওহাইও নদীর বন্দর শহর হান্টিংটনের উদ্দেশ্যে।
ওয়াগনের পেছন দিকটায় আরামদায়ক শোবার ব্যবস্থা আছে। আহমদ মুসাকে সেখানে শোয়ানো হলো।
বেডের পাশেই এ্যাটেনডেন্টের সিটে বসেছে জিভারো এবং সামনে বসে প্রফেসর আরাপাহো এবং ওগলালা।
গাড়ি চলতে শুরু করলে আহমদ মুসা বলল, ‘অনুমতি দিলে আমি বসতে পারি। একটুও জ্বর নেই। আমি সুস্থ। শুয়ে থাকলে আমি চারদিকের দুর্লভ দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।’
‘তাই কি? জিভারো গা’টা দেখতো।’ হেসে বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘সত্যি আব্বা, গায়ে তাপ নেই।’ কপাল পরীক্ষা করে জিভারো বলল।
‘না আব্বা, ওকে উঠতে দিও না। জ্বর ছাড়লেই বুঝি মানুষ সুস্থ হয়ে যায়?’ বলল ওগলালা।
‘ঠিক বলেছ মা। তবে যেহেতু সে এসেছে নতুন, এই বিবেচনায় তাকে বসার সুযোগ দেয়া যায়।’
‘ধন্যবাদ স্যার, ওগলালা ভেটো দেবার আগেই আমি উঠে বসলাম।’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘ভেটোকে ভয় করার কিছু নেই। ভেটোর সেই সুদিন আর নেই।’
‘সুদিন আছে। বলুন, ঠান্ডা যুদ্ধের পর ভেটো দেবার মত দেশ নেই।’
প্রফেসর আরাপাহোর মুখে মুগ্ধ হাসি। বলল, ‘বৎস আহমদ মুসা, তোমাকে যতই দেখছি আমি বিস্মিত হচ্ছি। এমন বিপ্লবীর কাঠিন্য, রাশভারি আচরণ, রুচির নিরসতা, বুলেটের মত নির্দয় গতি, প্রভৃতি কিছুই নেই তোমার মধ্যে। এমন কাগজের মত সাদা মন আর শিশুর মত সারল্য নিয়ে তুমি বিপ্লবী কেমন করে? তোমার মত সংবেদনশীল লোকের লেখক-কবির মত শিল্পী হওয়া উচিত।’
‘না আব্বা, উনি সমাজ সংস্কারক বা মিশনারী হলে মানাতো ভাল। মানুষের মন গড়ার মাধ্যমে দেশ গড়তে উনি ভাল পারতেন।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল ওগলালা।
‘তাহলে কথাটা দাঁড়াচ্ছে, আমাদের সন্মানিত আহমদ মুসা ভাই ‘অল ইন ওয়ান’।’ বলল জিভারো।
‘জিভারোর কথায় যে মানুষের ছবি ভেসে ওঠে, তা ‘অল পারফেক্ট’ বা পূর্ণ মানুষের ছবি। এমন অল পারফেক্ট মানুষ শুধু আল্লাহর বার্তাবাহী নবি-রাসুল বা প্রফেটরাই হতে পারেন। যেমন জগতের শেষ প্রফেট মুহাম্মদ (সঃ)। তাঁরা মডেল। তাদের অনুসরণে মানুষ পারফেক্ট হবার চেষ্টা করবে। কিন্তু ঐ পর্যায়ে পৌঁছা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। সুতরাং ‘অল ইন ওয়ান’ আর কেও হতে পারেনা।’ বলল আহমদ মুসা গভীর কণ্ঠে।
‘সব প্রফেটই কি সম্পূর্ণ মানুষ?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘অবশ্যই।’
‘কিন্তু তোমাদের প্রফেট যুদ্ধ করেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, যিশু তা করেননি।’ প্রফেসর আরাপাহো বলল।
‘যিশু পূর্ণ মানুষ তার সময়ের জন্যে। আর একটি কথা, সব প্রফেট কে সমান দায়িত্ব দিয়ে পাঠানোও হয়নি। যেমন যিশু এশেছেন বনি ইসরাইলের জন্যে, কিন্তু শেষ প্রফেট এসেছেন বিশ্বের সব মানুষের জন্যে এবং সর্বকালের জন্যে।’
‘ও নাইস, নাইস! আমরা যিশুর ধর্ম গ্রহণ করিনি। ঠিক করেছি। সারা পৃথিবীর জন্যে যিনি, সর্বকালের জন্যে যিনি, তার ধর্মই মানুষের সত্যিকারের ধর্ম।’ আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠল ওগলালা।
‘ঠিক বলেছ ওগলালা। তবে এটা নিয়ে এসো আরও ভাবি। আহমদ মুসার কাছে আরও জানা যাবে।’
বলে একটু থেমেই প্রফেসর আরাপাহো আবার বলল, ‘ওগলালার কথাই ঠিক, তুমি প্রকৃতই মানুষ গড়া ও সমাজ গড়ার লোক। কিন্তু তোমার হাতে আবার বন্দুক কেন?’
‘কারন আমার প্রফেট যুদ্ধ করেছেন, দেশ শাসন করেছেন। স্রষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধের জন্যে। আজ অন্যায়ের প্রতিরোধ কি বন্দুক ছাড়া সম্ভব?’
‘বুঝেছি, তমাদের মিশন শুধু উপদেশ দেয়ার নয়, আদেশ দেয়ারও। সত্যিই এই বৈশিষ্ট্য অনন্য।
প্রফেসর আরাপাহোর কণ্ঠ থামতেই ড্রাইভারের কণ্ঠ ভেসে এল, স্যার আমরা পশ্চিম ভার্জিনিয়া স্টেটে প্রবেশ করছি।’
সবাই তাকাল সামনে।
কথায় কথায় তারা অনেকটা পথ চলে এসেছে।
‘আহা, আমি অনেক দৃশ্য মিস করেছি।’ বলে আহমদ মুসা দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো বাইরে।
ওহাইও নদীর জল কেটে এগিয়ে চলেছে সুন্দর বিলাসবহুল মোটর বোট টি।
প্রফেসর আরাপাহোর ভাড়া করা এ বোট টি আগেরটার চেয়ে বড় এবং সুন্দরও। এবার আরও বেশিক্ষণ বোটে থাকতে হবে। ওহাইও নদীর ৯০০ কিলোমিটার এবং মিসিসিপি’র ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে কাহোকিয়াতে পৌঁছার জন্যে।
ওহাইও, মিসিসিপি আহমদ মুসার স্বপ্নের নদীগুলোর অন্যতম।
সেই স্বপ্নের নদীর নীল জলে ভেসে ভেসে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসা।
ওহাইওকে সীমান্ত নদী বলা যায়। সব সময় এর গতি দুই স্টেটের সীমান্ত দিয়ে। হান্টিংটন পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে পশ্চিম ভার্জিনিয়া ও ওহাইও স্টেটের সীমান্ত দিয়ে। হান্টিংটনের পর ২০০ কিলোমিটার চলল ওহাইও এবং কেনটাকি স্টেটের সীমান্ত রেখা ধরে। এখন এগিয়ে চলছে কেনটাকি এবং ইন্ডিয়ানা স্টেটের সীমান্ত বরাবর।
আহমদ মুসা বোটের দু’তলার ডেকে ইজি চেয়ারে বসে উপভোগ করছে চারদিকের দৃশ্য। তার বামদিকে কেনটাকি স্টেট আর ডান দিকে নদীর ওপারে ইন্ডিয়ানা স্টেট।
ওগলালা এসে প্রবেশ করলো ডেকে। পাশেই এক চেয়ারে বসল। তার পোশাকে বেশ পরিবর্তন এসেছে। মিনিস্কার্ট ও টাইট প্যান্টের বদলে সে এখন পরেছে লম্বা স্কার্ট, গাউন ধরনের ঢিলা জামা হাতাওয়ালা। এখন এসেছে মাথায় রুমাল জড়িয়ে।
চেয়ারে বসে সে বলল, ‘দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে?’
আহমদ মুসা ওগলালার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, ‘আমি বলব না,তুমিই বল তোমার কেমন মনে হচ্ছে?’
হাসল ওগলালা। বলল, ‘খুবই ফরমাল মনে হচ্ছে। এভাবে কি সর্বক্ষণ কেউ থাকতে পারে? না চলাফেরা সম্ভব এভাবে?’
‘তার মানে ভাল লাগছে না।’
‘ঠিক তা নয়। আমাকে নতুন মনে হচ্ছে। আর যেহেতু ভাল লাগাটা রিলেটিভ। এজন্যে কাউকে এটা ভালও লাগতে পারে, মন্দও লাগতে পারে।’
‘কিন্তু তোমার তো নিজস্ব ভাল লাগা মন্দ লাগা আছে।’
‘হঠাৎ নিজেকে যেন দায়িত্বশীল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, অন্যদের সাথে ধুম-ধারাক্কা, হৈচৈ, লাফালাফি যেন আমার জন্যে নয়। হাসি পাচ্ছে এটা ভাবতে।’
এ সময় ডেকে প্রবেশ করলো জিভারো। বলল ওগলালার দিকে তাকিয়ে, ‘বাহ!তোকে তো সুন্দর মানিয়েছে।’
‘তুমি বিদ্রূপ করছ নাতো ভাইয়া?’ বলল ওগলালা।
‘না সত্যি বলছি, তোকে অনেক ‘এলিট’ মানে অনেক মর্যাদা সম্পন্ন মনে হচ্ছে।’
‘ঠিক বলেছ জিভারো, শালিন পোশাকে মেয়েদের মর্যাদা সম্পন্ন করে তোলে। মানুষ তাদেরকে খারাপ দৃষ্টিতে নয়, মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে।’
‘কিন্তু মেয়েদেরকেই শুধু শালিন ও সংযত হতে হবে কেন ? আপনাদের ধর্মে মেয়েদের জন্যে অবাধ মেলামেশাকে আপত্তিকর বলা হয়েছে কেন ?’ বলল ওগলালা আহমদ মুসার দিকে ফিরে বসে।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘অবাধ মেলামেশা শুধু মেয়েদের জন্যে নয়, ছেলেদের জন্যেও আপত্তিকর বলা হয়েছে। তবে মেয়েদেরকে বেশী শালিন, সংযত ও চলাফেরায় সাবধান হতে বলা হয়েছে এজন্যে যে, একদিকে মেয়েরা আত্মরক্ষায় দুর্বল, আর অন্য দিকে ছেলেরা সবল ও মেয়েদের ব্যাপারে আক্রমণাত্মক। কোন অঘটন ঘটলে, তাতে ক্ষতিও হয় মেয়েদের বেশী।’
‘বুঝেছি ভাইয়া আপনি যা বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু মেয়েদের শালিন, সংযত ও সাবধান হওয়াই কি পুরুষের এই যুলুম ও অবিচারের প্রতিকার ? কেন…।’
আহমদ মুসা ওগলালা কে বাধা দিয়ে হেসে বলল, ‘বুঝেছি তোমার কথা। এটুকুকেই প্রতিকার বলা হয়নি। যে পুরুষের দ্বারা এ ধরনের অঘটন ঘটবে, তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর শাস্তির ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ধর্ষণকারী যদি অবিবাহিত হয়, তাহলে প্রকাশ্যে ও জনসমক্ষে ৮০টি বেত্রাঘাতের শাস্তি দেয়া হয়েছে। আর যদি সে বিবাহিত হয়, তাহলে প্রকাশ্যে ও জনসমক্ষে তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যার বিধান দেয়া হয়েছে। এ ধরনের শাস্তির ব্যাবস্থা করা হলে ধর্ষণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।’
‘কিন্তু ভাইয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণকে ধর্ষণ হিসেবে প্রমাণ কারা যায় না।’ বলল জিভারো।
‘এ কারনেই দাম্পত্য জীবনের বাইরে সব ধরনের অবৈধ অঘটনকে আমাদের ধর্ম ব্যাভিচার বা অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। উভয় পক্ষের সম্মতিতে হোক অসম্মতিতে হোক এই অপরাধের একই ধরনের শাস্তির বিধান করা হয়েছে।’
‘সাংঘাতিক ! আমাদের সমাজে এটা অকল্পনীয়।’ জিভারো বলল।
‘সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এর প্রয়োজন আছে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি ভাবছি ভাইয়া। আমি সমর্থন করছি আপনাকে, আপনাদের আইনকে। ধন্যবাদ নতুন এক শিক্ষার জন্যে।’
কিছু বলতে যাচ্ছিল জিভারো, কিন্তু হঠাৎ নারী ও পুরুষ কণ্ঠের সম্মিলিত চিৎকারে তার কণ্ঠ থেমে গেল। তিনজনই এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল।
কেবিন থেকে বেরিয়ে এল প্রফেসর আরাপাহো।
চার জনই গিয়ে দাঁড়াল যেদিক থেকে চিৎকার আসছে সেদিকে রেলিং-এর ধারে। দেখল তারা, একটা মোটর বোটে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে পৌঢ় নারী-পুরুষ। স্বামী-স্ত্রী হবে। বোটের একটু দূরে একটি বালক হাবুডুবু খাচ্ছে পানিতে।
নদীর এই জায়গাটা জনবিরল এবং মোহনা ধরনের। সামনেই একটা শাখা নদী বেরিয়ে গেছে ওহাইও কেনটাকির দিকে। সে কারনেই সম্ভবত নদিতে স্রোত এখানে বেশ জোরালো।
ঐ স্বামী- স্ত্রীর চিৎকারে ডুবন্ত বালকটির দিকে তাকিয়ে এসেট ওসেট দুই বোটের সবাই শোরগোল করে উঠছে।
আহমদ মুসা ডুবন্ত বালকটিকে দেখার সাথে সাথেই গা থেকে কোট ও পা থেকে জুতা খুলে ছুড়ে ফেলে রেলিং-এ উঠে দাঁড়াল।
জিভারো ও ওগলালা দু’জনেই এটা দেখে আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে উঠল, ‘আপনি এভাবে নামবেন না । এখানে ওহাইও’র স্রোত খুব খারাপ, তার উপর আপনি অসুস্থ। আর এত উঁচু থেকে লাফ দিতে পারেন না।’
কিন্তু তাদের কথা আহমদ মুসা যেন শুনতেই পেল না। দু’হাত সামনে বাড়িয়ে মাথা নিচু করে লাফ দিয়েছে সে। বাজপাখির মত নেমে গেল নদীর পানি লক্ষ্যে। পানিতে পরল না, পানিতে ঢুকে গেল তীরের মত নিঃশব্দে।
দুইটি বোট থেকে দজন খানেক চোখের দৃষ্টি তার দিকে ছুটে গেল।
কিন্তু পানিতে সেই যে ঢুকে গেল, উঠল না সে। সব চোখ আশা করছে সে সাঁতরে দ্রুত এগিয়ে যাবে ছেলেটির কাছে। ছেলেটি যে ডুবে যাচ্ছে। সত্যিই ডুবে গেল। দেখা যাচ্ছে না ছেলেটিকে আর।
ডুকরে কেঁদে উঠল পৌঢ় নারী-পুরুষ। হায় হায় করে উঠল দুই বোটের মানুষ।
কোথায় আহমদ মুসা?
সেও কি ডুবে গেল নাকি! আর্তনাদ করে উঠল ওগলালা।
ঠিক এ সময়েই ছেলেটি যেখানে ডুবে গিয়েছিল, সেখান থেকে আট-দশ গজ দূরে ছেলেটিকে এক হাত উপরে তুলে ধরে ভেসে উঠল আহমদ মুসা।
দুই বোটের সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। পৌঢ় দুই নারী-পুরুষ দু’হাত উপরে তুলে ঈশ্বরকে ডাকতে লাগল।
আহমদ মুসা বালকটিকে এক হাতে ঐভাবে উঁচু করে ধরে সাঁতরে এগুলো বোটের দিকে স্রতের প্রতিকুলেই। বোটও এগুতে লাগল আহমদ মুসার দিকে।
বোট থেকে দড়ির মই নামিয়ে দেয়া হলো।
আহমদ মুসা ছেলেটিকে নিয়ে দড়ির মইয়ে দাঁড়ালে ওরা তাদের বোটে তুলে নিল।
ছেলেটির পেট পানিতে ভর্তি। কিন্তু সম্পূর্ণ সংজ্ঞা হারায়নি সে তখনও।
আহমদ মুসা ছেলেটিকে নিয়ে ডেকে এসে নামতেই প্রৌঢ়া মহিলাটি হুমড়ি খেয়ে পড়ল বালকটির উপর। প্রৌঢ় লোকটি মহিলাটিকে টেনে তুলে বলল, ‘আগে ছেলেটিকে বাঁচতে দাও।’
‘ধন্যবাদ।’ প্রৌঢ়টির উদ্দেশ্যে কথাটি বলে আহমদ মুসা বালকটির পেট থেকে পানি বের করার প্রক্রিয়া শুরু করল।
ততক্ষণে প্রফেসস আরাপাহো তার বোট এ বোটের গায়ে ভিড়িয়ে ওগলালা ও জিভারোকে নিয়ে নেমে এসেছে এ বোটে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই ছেলেটির পেটের পানি বের হয়ে গেল এবং ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠল।
প্রৌঢ় লোকটি ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে তুলে দিল প্রৌঢ়া মহিলাটির কোলে। মহিলাটি তাকে বুকে জড়িয়ে আরেক দফা কেঁদে উঠল।
প্রৌঢ় লোকটি আহমদ মুসার দু’হাত জড়িয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ বাবা। ঈশ্বর তোমার ভাল করবেন।’
বলেই প্রৌঢ় লোকটি ছুটে গেল তার কেবিনে। মিনিট খানেক পরেই বেরিয়ে এল একটি চেক হাতে করে। চেকটি আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘একমাত্র নাতির নবজীবন লাভে আনন্দিত তার দাদুর পক্ষ থেকে এক লাখ ডলার উপহার দিলাম বাবা।’
আহমদ মুসা চেক হাতে নিল। তারপর বালকটির গালে তকা দিয়ে আদর করে প্রৌঢ়টিকে বলল, ‘এ আপনার নাতি। সেই সাথে এ ঈশ্বরের সুন্দরতম সৃষ্টি মানুষের একজন এবং এই হিসেবে এ আমারও ভাই। এ ছোট ভাইয়ের জন্যে আমার এ ছোট্ট উপহার গ্রহণ করুন।’
বলে আহমদ মুসা চেকটি প্রৌঢ়ের হাতে তুলে দিল।
প্রৌঢ়টি বিস্মিত চোখে কম্পিত হাতে চেকটি গ্রহণ করলো। বলল, কে তুমি বাবা এত সুন্দর কথা বল? তুমি চার্চের ফাদার হলে আমি বিস্মিত হতাম না। কিন্তু তোমদের মত নব্য যুবকের জন্যে এটা বিস্ময়। যাই হোক, যে ভাবেই হোক তুমি আমার উপহার প্রত্যাহার করলে বাবা।’
‘তাহলে কি আপনি চান পরোপকার, মানব সেবা, কারও বিপদে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি লাভজনক ব্যাবসায় পরিনত হোক ?’
প্রৌঢ় কথা বলল না। স্তম্ভিত চোখ তার আহমদ মুসার উপর নিবিদ্ধ। এক সময় সে আহমদ মুসার দু’হাত চেপে ধরে বলল, ‘এস বাবা, তোমার সাথে একটু কথা বলি। এক দুর্লভ যুবক তুমি।’
এগিয়ে এল ওগলালা। বলল প্রৌঢ়কে, ‘মাফ করবেন আংকল, ওর কাপড় পাল্টানো দরকার। ঠাণ্ডায় ওর ক্ষতি হবে।
আহমদ মুসা প্রৌঢ়ের সাথে ওগলালা, জিভারো এবং প্রফেসর আরাপাহোর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি ওঁদের অতিথি। আমি চলি জনাব।’
প্রৌঢ় আহমদ মুসার হাত ছেড়ে দিয়ে ওঁদের সাথে সম্ভাষণ বিনিময় করল। তারপর আহমদ মুসার দিকে ফিরে বলল, ‘ঠিক, তাড়াতাড়ি তোমার কাপড় পাল্টানো দরকার।’
বলে পকেট থেকে নিজের পরিচিতি কার্ড বের করে আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘তুমি কি আমেরিকান?’
আহমদ মুসা কার্ড হাতে নিয়ে বলল, ‘না, আমি আমেরিকান নই।’
‘আমার পরিচয় তোমার কাছে থাকল। সময় করে যদি দেখা করো, তাহলে আমি এবং আমার ছেলে খুব খুশী হবো। তাছাড়া তোমার কোন প্রয়োজনে যদি আমি লাগতে পাড়ি, তাহলে নিজেকে সউভাগ্যবান মনে করব।’ বলল প্রৌঢ় কৃতজ্ঞতা ভরা কণ্ঠে।
প্রৌঢ় প্রফেসর আরাপাহোর দিকেও ফিরল। বলল, ‘প্রফেসর নামে আপনাকে চিনি। খুশী হলাম দেখা হওয়ায়। আপনারাও আমার কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।’
আহমদ মুসা ওগলালাদের বোটে পার হয়ে প্রৌঢ়ের পরিচিতি কারদের দিকে নজর দিল। ভাল করে নজর পড়তেই চমকে উঠল। নাম জর্জ আব্রাহাম জনসন। পরিচয় ডাইরেক্টর ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)।
আহমদ মুসারা পাশাপাশি হেঁটে কেবিনে চলে এসেছিল।
‘কার্ডে কি পড়লেন ভাইয়া ? লোকটি কে?’ জিজ্ঞেস করলো ওগলালা।
‘লোকটি এক অর্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পাওয়ারফুল ব্যাক্তি। এফবিআই-এর ডাইরেক্টর জর্জ আব্রাহাম জনসন।’ বলে আহমদ মুসা কার্ডটি তুলে দিল ওগলালার হাতে।
নাম শুনার সাথে সাথে তারা তিনজনই দাঁড়িয়ে পড়েছে। প্রফেসর আরাপাহো ওগলালার হাত থেকে কার্ডটি নিল। কার্ডটির দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলল, ‘ঠিকই বলেছ আহমদ মুসা তার শক্তি সম্পর্কে। আগে জানলে আরও আলাপ করা যেত।’
‘আব্বা ওঁকে আর না আটকানো উচিত। ওর কাপড় পাল্টানো দরকার।’
বলেই ওগলালা আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি গরম সাওয়ার নেবেন। উপকার হবে।’
‘ধন্যবাদ ওগলালা। মেয়েদের সংসার জ্ঞান সত্যি মজ্জাগত। এই বয়সে এত বিষয় জান কি করে ? সান ওয়াকার সত্যিই বলে ‘go back to kitchen.’
‘আমি এর প্রতিবাদ করছি। আপনার ধর্ম ইসলামও এ কথা বলেনা। কিন্তু পরে কথা হবে, আপনি যান।’
আহমদ মুসা মিনিট দশেকের মধ্যেই ফিরে এল।
একটা ডেকে টেবিল ঘিরে ওরা তিনজন বসে। চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে বসে ওরা।
আহমদ মুসাও বসল।
সঙ্গে সঙ্গেই ওগলালা এক কাপ গরম চা আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘চা দিলাম বলে আমি ‘রান্নাঘর’-এর উপযুক্ত বলে বসবেন না যেন।’
‘কেন বলব ? তুমিই তো বলেছ আমাদের ধর্ম ইসলাম এটা সমর্থন করে না।’
‘কি বলে সেই কথাও সবাইকে বলুন।’ বলল ওগলালা
‘বলে মেয়েরা উপযুক্ত পরিবেশ তাদের মন-মানসিকতা ও সামর্থের সাথে সঙ্গতিশীল সব কাজই করতে পারবে।’
‘ধন্যবাদ। আরও ধন্যবাদ এ জন্যে যে, আপনি এক লাখ টাকার উপহার ফেরত দিয়েছেন মিঃ জর্জ আব্রাহাম জনসনকে। আমার মন আকুলি-বিকুলি করছিল আপনার পরিচয় তাকে দেবার জন্যে। তাহলে সে বুঝতো, আহমদ মুসার মানবিকতা ও মহত্ত্ব কতবড় এবং কিভাবে সে হৃদয়ের ঐশ্বর্য দিয়ে প্রাচুর্যকে পদাঘাত করতে পারে।’
ওগলালা একটু থেমেছিল।
সেই সুযোগে কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল জিভারো।
কিন্তু ওগলালা ‘আমার আসল কথাই বলা হয়নি ভাইয়া’ বলে থামিয়ে দিল জিভারো কে। তারপর আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, আপনার প্রাপ্ত ধন্যবাদ দিয়েছি। এখন প্রাপ্ত নিন্দার কথা বলি, আপনার ঐভাবে নদীতে লাফিয়ে পড়া ঠিক হয়নি। এক অঘটনের প্রতিকার করতে গিয়ে আরেক অঘটন ঘটতে পারতো।
‘কিন্তু ওগলালা কোন অঘটন ঘটেনি। অন্যদিকে একটা জীবন বেঁচেছে। এজন্যে ওঁকে ধন্যবাদ দেয়া প্রয়োজন।’ বলল জিভারো।
‘ঘটেনি কিন্তু ঘটতে পারতো। এ থেকে ভবিষ্যৎ এর জন্যে শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন।’ বলল ওগলালা।
জিভারো কিছু বলতে যাচ্ছিল।
প্রফেসর আরাপাহো তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘তোমার কথাও ঠিক, ওগলালার কথাও ঠিক। কিন্তু এই দুই কথার কোনটাই আহমদ মুসার জন্যে প্রয়োজন নেই। আহমদ মুসাকে আমরা নামে চিনেছি। কার্যক্ষেত্রে একঝলক দেখার সৌভাগ্য হলো। তবে ঈশ্বর কে বলি, তাকে কার্যক্ষেত্রে এমন ভাবে দেখার যেন প্রয়োজন না হয়।’
‘ঠিকই বলেছেন আব্বা। তবে কিছু কাজ না দেখালে দুর্লভ সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হবো।’ বলল ওগলালা।
‘কিন্তু এই যে তুমি তাকে নসিহত করলে ঐভাবে ঝুঁকি না নিতে।’
ওগলালা সলাজ হাসল। বলল, ‘সব কাজ, সব ঘটনাই তো আর পর্বতপ্রমাণ উঁচু থেকে নদীর ঘূর্ণিপাকে ঝাঁপিয়ে পড়া নয়।’
হেসে উঠল প্রফেসর আরাপাহো এবং জিভারো।
হাসি দেখে ভ্রূকুটি করল ওগলালা। লজ্জা ও অপমানের চিহ্ন ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। হাত থেকে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল ওগলালা এবং কোন কথা না বলে গট গট করে হেঁটে কেবিনের ভেতরে চলে গেল।
‘ঠিক ছোট্টটিই রয়ে গেছে একেবারে। দৈত্য-দানবের কেচ্ছা শুনবে, কিন্তু কোলের নির্ভয় আশ্রয়ে বসে।’ হাসতে হাসতে বলল প্রফেসর আরাপাহো।
কথা শেষ করেই প্রফেসর আরাপাহো নদীর ডান পাড়ে ইন্ডিয়ানা স্টেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই যে সবুজ সুন্দর রাজ্যটি দেখছ, আমেরিকার অন্যান্য স্থানের মত এখানেও রেড ইন্ডিয়ানদের রক্তের স্রোত বইয়েছে। ১৭৭৯ সালে পরাজিত ব্রিটিশ বাহিনী এই অঞ্চল মার্কিন বাহিনীর হাতে ছেরে দেয়। কিন্তু রেড ইন্ডিয়ানরা তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে দিতে চায়নি। মার্কিন বাহিনী দু’বার পরাজিত হয় রেড ইন্ডিয়ানদের হাতে। আঠার বছরের অব্যাহত লড়াইয়ের পর মার্কিন বাহিনী এখানকার বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতিরোধ নির্মূল করে শক্তির জোরে। আজ তুমি এই ইন্ডিয়ানা স্টেটে কোন ইন্ডিয়ান খুঁজে পাবেনা।’
প্রফেসর আরাপাহোর শেষ কথাটা আবেগে ভারি হয়ে উঠল।
আহমদ মুসা সমবেদনার সুরে নরম কণ্ঠে বলল, ‘এই রক্তলেখা কাহিনী পৃথিবীর বহুদেশে আছে। কিন্তু আপনাদের কাহিনীর চেয়ে মর্মন্তুদ আর কোনটাই নয়।’
বলে একটু থেমেই আহমদ মুসা বলল আবার, ‘আপনারা বাড়তি যে ৭১৫ টি রিজার্ভ এলাকা দাবী করেছেন, তার মধ্যে এই ইন্ডিয়ানা স্টেটের কোন এলাকা আছে?’
‘আছে। ওয়াবাল নদী উপত্যকা এবং মিশিগান হ্রদ সংলগ্ন ‘সাউথ বেন্ড’ এলাকা।’
‘কিন্তু আপনারা রিজার্ভ এলাকা দাবী করার মাধ্যমে কি নিজেদের ‘জাতি’ হওয়ার বদলে ‘উপজাতি’তে পরিণত করেছেন নাকি ?’
‘তুমি ঠিক বলেছ। তার অর্থ এটাই বুঝায়। কিন্তু এটা আমাদের একটা কৌশল। আমাদের যোগ্য করে তৈরি করার কৌশল। এর পরের পদক্ষেপ হবে জাতীয় জীবনের সর্বত্র আমাদের ন্যায্য অংশ আদায় করা।’
‘কিন্তু শ্বেতাঙ্গ বা ইউরোপিয়ানদের বৈরী নীতি অনুসরনে তা করা ঠিক হবে না।’
‘সেটা এখন আমাদের নীতিও নয়। ভাই হওয়ার সমানাধিকার নিয়েই আমরা আমাদের অংশ চাইব। এবং আমরা জানি মুষ্টিমেয় বর্ণবাদী ছাড়া অধিকাংশ আমেরিকান এবং মার্কিন সংবিধানের সমর্থন আমরা পাব।’
প্রফেসর আরাপাহো কথা শেষ করতেই কেবিনের দরজায় ওগলালা এসে আদালতের ঘোষকের মত হাঁক ছাড়ল, ‘খাদ্য খাবার টেবিলে প্রস্তুত। সকলকে খাদ্য গ্রহনের জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।’
প্রফেসর আরাপাহো উঠল। তার সাথে আহমদ মুসা এবং জিভারো।
তখন বোট চলছে ইলিনয় স্টেট ও কেনটাকির সীমান্ত দিয়ে। ক’মিনিট আগে ওয়াবাশ নদীর সংযোগ স্থল পেরিয়ে এসেছে। এখানে ওহাইওতে মিশিগান হ্রদের পানি সমৃদ্ধ ওয়াবাশ নদীর পানি যুক্ত হওয়ায় নদীর গতি অপেক্ষাকৃত বেগবান।
এখান থেকে মিসিসিপির সংযোগ স্থল পর্যন্ত প্রায় দু’শ কিলোমিটার এলাকা ইলিনয় স্টেটের জনবিরল প্রেইরীর অংশ। দু’ধারেই বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। নদীর দু’ধারে ঝোপঝাড়, গাছ-পালা অবশ্যই আছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য শহর বা জনপদ এই দু’শ কিলমিতারের মধ্যে নেই, একমাত্র পাদুকান শহর ছাড়া। পাদুকান শহর ওহাইও এবং কেনটাকি নদীর সংযোগ স্থলে অবস্থিত।
কেনটাকি নদীর ২৫ কিলোমিটার আগে বার্কলে নদী।কেনটাকির মতই এ নদী ওহাইও থেকে বেরিয়ে কেনটাকির মধ্য দিয়ে দক্ষিণ দিকে টিনেমির দিকে এগিয়ে গেছে।
বোট তখন বার্কলে’র উৎসের মুখে প্রায় পৌঁছে গেছে।
বোটের দু’তলার ডেকে বসে গল্প করছে ওরা চারজন, প্রফেসর আরাপাহো, আহমদ মুসা, জিভারো এবং ওগলালা।
হঠাৎ বাম দিকের তীর থেকে একটি জোরালো ও ভারি কণ্ঠ ভেসে এল, ‘বোট ভিড়াও এদিকে।’
চমকে উঠল আহমদ মুসারা। ভয় ফুটে উঠল প্রফেসর আরাপাহোর চোখে-মুখে।
‘পুলিশ নাকি?’ বলল ওগলালা।
‘না, পুলিশ অবশ্যই নয়। নৌ-পুলিশ হলে তাদের বোট থাকতো। আমার মনে হচ্ছে, এরা অন্য কেউ। এখান থেকে মিসিসিপি পর্যন্ত এই এলাকাটা ভাল না।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
আহমদ মুসা ভাবছিল। তার দৃষ্টি তীরের দিকে। তীরে ওরা দশ বারোজন লোক। সবাই বসে। যে কথা বলছে সে দাঁড়িয়ে। তার হাতে আধুনিক রাইফেল।
ওদিক থেকে আর কোন কথা এলোনা। এল বন্দুকের শব্দ। তীরের সেই লোকটির হাতের বন্দুক মোটর বোটের দিকে তাক করা।
বন্দুকের গুলী হবার মুহূর্তেই একটি গুলী এসে বিদ্ধ করল বোটের ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডকে।
চখের পলকে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডটি কোথায় উড়ে গেল!
গুলীর প্রায় সাথে সাথে তীরের সেই কণ্ঠটি আবার ধ্বনিত হলো, ‘দু’বার আমি নির্দেশ করিনা। বোট না ভেড়ালে বোমা মেরে উড়িয়ে দেব।’
প্রায় মরার মত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে জিভারো এবং ওগলালার মুখ। ভয় ও উদ্বেগে মুষড়ে পড়েছে প্রফেসর আরাপাহো।
আহমদ মুসা তাদের দিকে একবার তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। ডেকের সামনের দিকটায় এগিয়ে বলল, ‘বোট ভিড়ানো হচ্ছে।’
বলে আহমদ মুসা রেলিং পাশে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ক্রুদের বলল, ‘বোট তীরে ভেড়াও।’
আহমদ মুসা ফিরে এল প্রফেসর আরাপাহোদের কাছে।
প্রফেসর আরাপাহো ভীত ও শুষ্ক কণ্ঠে বলল, ‘বোট ভেড়ানো কি ভাল হলো। শুনেছি ওরা নিষ্ঠুর ও জঘন্য প্রকৃতির লোক। এই এলাকায় আগেও নৌ-ডাকাতি ও হাইজ্যাকের ঘটনা ঘটেছে।’
‘উপায় কি। মিথ্যা হুমকি ওরা দেয়নি। সত্যিই ওরা বোট উড়িয়ে দিতে পারতো।’ একান্ত স্বাভাবিক ও উদ্বেগহীন কণ্ঠে বলল আহমদ মুসা।
‘আমার ভয় করছে। বোট ওরা তীরে ভেড়াতে বলছে কেন? ওরা কি করতে চায় আমাদের?’ বলল ওগলালা।
‘যা ঘটার তাই ঘটবে। ভয় করে লাভ কি? ইশ্বরের উপর ভরসা কর।’ বলল আহমদ মুসা।
বোট ভিড়েছে।
তীরের লোকদের নির্দেশে সংযোগ সিঁড়িও নামিয়ে দেয়া হয়েছে তীরে।
সিঁড়ি লাগার সঙ্গে সঙ্গে ওরা সিঁড়ি বেয়ে ঝড়ের বেগে উঠে এল বোটে।
সাতজন ওরা।
সাতজনের মধ্যে সবার আগে যে বোটে উঠল তার হাতে স্টেনগান এবং কোমরে ঝুলানো রিভলবার। আর অন্যদের হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। সবাই শ্বেতাঙ্গ।
বোটে উঠে প্রফেসর আরাপাহোদের দিকে নজর পড়তেই সবাই হৈহৈ করে উঠল, ‘ব্যাটা ইন্ডিয়ান! তোদেরই মুখ দেখতে হলো।’
আর আহমদ মুসার দিকে নজর পড়তেই স্টেনগানধারী বলে উঠল, ‘আর তুই কে হে। তকে তো এশিয়ান কালা আদমী মনে হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আমি এশিয়ান। এখন বল, তোমরা বোট ভিড়াতে বললে কেন ?’
লোকটি হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘তোদের আদর-সোহাগ করার জন্যে বোট ভেড়াতে বলেছি’। বলে আবার একবার হাসল কুৎসিত কণ্ঠে।
ওরা বোটে উঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রফেসর আরাপাহো, জিভারো ও ওগলালা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
ওগলালা ছুটে এসে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসার পেছনে। তার ভীত মুখ রক্তহীন পাণ্ডুর।
হাসি থামিয়ে স্টেনগানধারী লোকটি আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তর পেছনে ওটা কে? খাসা সুন্দরী তো! আহ! মেঘ না চাইতেই জল!’
‘দেখ এঁরা সম্মানি লোক।’ তারপর প্রফেসর আরাপাহোর দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘উনি একজন সম্মানিত প্রফেসর। এরা দুজন ওঁর ছেলেমেয়ে। এঁরা পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে।’
লোকটি আবার সেই হেঁড়ে স্বরে হো হো করে হেসে উঠল। বলল, গরুর রাখাল যাযাবর ব্যাটারা আবার কবে সম্মানি হল?’
কথা শেষ করেই সাথীদের দু’জনকে নিরদেশ দিল, ‘তোমরা নিচে যাও। বোটের ক্রুদের ঠিক করো।’ অন্যদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এদের সার্চ করো। টাকা-পয়সা, অস্ত্রপাতি কিছু আছে কিনা দেখ। সুন্দরীকে সার্চ করার দরকার নেই, ওকে সার্চের কাজটা আমিই পড়ে করব।’
সার্চ হয়ে গেলে লোকটি প্রফেসর কে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমরা বোট থেকে নেমে যাও’।
প্রফেসর আরাপাহো তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা বলল, ‘মিঃ প্রফেসর এদের সাথে ঝগড়া করে লাভ নেই। চলুন আমরা নেমে যাই’।
প্রফেসর আরাপাহোর মুখ মলিন হয়ে উঠল।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল যাওয়ার জন্যে। বোটের সিরির দিকে পা বাড়াবার আগে আহমদ মুসা বলল, ‘চল ওগলালা’।
আহমদ মুসার কথা শোনার পড় প্রফেসর আরাপাহো এবং জিভারো হাঁটা শুরু করেছে বোট থেকে নামার জন্যে।
আহমদ মুসা ওগলালাকে ডেকেছে বটে বোট থেকে নামার জন্যে, কিন্তু নিজে এক পা বাড়ায়নি চলার জন্যে।
এদিকে ওগলালা বোট থেকে নামার জন্যে চলা শুরু করার সাথে সাথে স্টেনগানধারী সরদার গোছের লোকটি বলল, ‘না সুন্দরী যাবে না। সে আমাদের সাথে থাকবে। কাল সকালে সুন্দরী ও বোট দুটোই তোমরা ফেরত পাবে।‘
বলেই সে এগুলো ওগলালাকে ধরার জন্যে।
চিৎকার করে ছুটে যাচ্ছিল ওগলালা তার পিতার দিকে। তার পিতা প্রফেসর আরাপাহো এবং জিভারো লোকটির কথা শোনার সাথে সাথেই থমকে দাঁড়িয়েছে।
ওগলালার পথ রোধ করে দাঁড়াল লোকটি।
ওগলালা বাধা পেয়ে ছুটে এসে আহমদ মুসার আড়ালে দাঁড়াল। তার মুখ মরার মত পাণ্ডু। কাঁপছিল সে আতঙ্কে।
আহমদ মুসা হাসি মুখে ওগলালার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভয় কি ওগলালা। ওরা তো আমাদের মত মানুষ।’
‘ঠিক বলেছ কালা এশিয়ান। তোমার বুদ্ধি আছে। তবে আমরা তোমাদের মত নয়, অনেক উৎকৃষ্ট মানুষ। সুন্দরীও বুঝবে আমাদের সাথে থাকার পর।’
বলে লোকটি এক পা দু’পা করে এগুতে লাগল ওগলালার দিকে।
লোকটির অবশিষ্ট চারজন সাথী দাঁড়িয়েছিল প্রফেসর আরাপাহো আগে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। আর প্রফেসর আরাপাহো এবং জিভারো দাঁড়িয়ে আছে বোটের আরেকটু সামনের দিকে।
লোকটি একদম কাছে এসে গেছে।
ওগলালা আহমদ মুসার গা ঘেঁষে পেছনে দাঁড়িয়েছিল।
লোকটি তার স্টেনগান ডান হাতে নিয়ে আহমদ মুসার ডান পাশ দিয়ে তার বাম হাত বাড়িয়ে এগুলো ওগলালাকে ধরার জন্যে।
লোকটির লক্ষ্য তখন তার শিকার ওগলালার দিকে।
আল্লাহর দেয়া এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তার ডান হাত বাড়িয়ে এক ঝটকায় স্টেনগানটা কেড়ে নিয়েই স্টেনগানের বাঁট দিয়ে আঘাত করল লোকটির ঘাড়ে। তারপর স্টেনগান সোজা করে নিয়েই একটু দূরে দাঁড়ানো চারজনকে লক্ষ্য করে স্টেনগানের ট্রিগার টিপল আহমদ মুসা।
ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা চারজন প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা ঐটুকু সময়েরই সুযোগ গ্রহণ করে। চারজন কিছু করার আগেই একই সাথে এক ঝাঁক গুলীর শিকার হয়ে ঝরে পড়ল মাটিতে।
এদিকে ঘাড়ে আঘাত পাওয়া লোকটি নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে মরিয়া হনে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল আহমদ মুসার উপর।
আহমদ মুসা ছিটকে পড়ে গেল ডেকের উপর।
লোকটি জাপটে ধরেছে ডেকে পড়ে যাওয়া আহমদ মুসাকে।
কিন্তু আহমদ মুসার হাত দু’টি মুক্ত থেকে গেছে। আহমদ মুসার ডান হাতে তখনও স্টেনগান। কিন্তু গুলী করার জো নেই।
আহমদ মুসা দু’হাতে স্টেনগান ধরে একটু উঁচু করে লম্বাভাবে আবার আঘাত করল লোকটির মাথায়। পর পর কয়েকবার।
আহমদ মুসাকে জাপটে ধরা লোকটির হাত কিছুতা শিথিল হয়ে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা নিজের দেহকে প্রবলভাবে ঘুরিয়ে দেহকে গড়িয়ে নিল এবং লোকটিকে ছিটকে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
ঠিক এই সময়েই জিভারো চিৎকার করে উঠল ‘পেছনে গুলী ভাইয়া’।
এ চিৎকার কানে যাবার সাথে সাথেই এক পাশে নিজের দেহকে ছিটকে দিল আহমদ মুসা। তার দেহটি মাটি স্পর্শ করার আগেই দুটি গুলী একই সাথে অতিক্রম করল তাকে। দাঁড়িয়ে থাকলে তার বুক ও মাথা ভেদ করতো গুলী দুটো।
আহমদ মুসা মাটিতে পড়েই তার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে পেছন দিকে। দেখতে পেল নিচের ডেক থেকে উঠে আসা সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে ওরা দু’জন তারা আবারও বন্দুক তাক করেছে আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা মুখ ঘুরিয়ে নেবার সাথে সাথে দু’হাতে ধরা তার স্টেনগানকেও সোজা করে নিয়েছিল। লোক দুটি তার চোখে পড়ার সাথে সাথেই স্টেনগানের ট্রিগার টিপল আহমদ মুসা তাদের লক্ষ্য করে।
ওরাও ট্রিগার টিপতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই স্টেনগানের ছুটে যাওয়া অনেক গুলীর গ্রাসে পরিণত হলো তারা।
তাদের দেহ গড়িয়ে পড়ল সিঁড়ি দিয়ে নিচে।
গুলী করেই তাকাল আহমদ মুসা তাকে আক্রমণকারী সেই লোকটির দিকে।
দেখল লোকটি টলতে টলতে উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার হাতে রিভলবার।
তার মাথার পেছন দিক স্টেনগানের বাঁটে ভালই আঘাত পেয়েছে। আহত জায়গা থেকে রক্ত গড়িয়ে তার পেছন পেছন ভিজে যাচ্ছে।
রিভলবার হাতে লোকটিকে যখন আহমদ মুসার চোখে পড়ল। তখন স্টেনগান ঘুরিয়ে গুলী করার সময় ছিল না। মুহূর্তও নষ্ট না করে আহমদ মুসসা স্টেনগান ছুড়ে মারল লোকটির রিভলবার ধরা হাত লক্ষ্যে।
ছিটকে পড়ল রিভলবার লোকটির হাত থেকে।
রিভলবার হাতছাড়া হলে লোকটি স্টেনগান কুড়িয়ে নেবার জন্যে ঝাপিয়ে পড়ল স্টেনগানের উপর।
স্টেনগান ছুড়ে দিয়েই আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল। সে ছুটে গেল লোকটির লক্ষ্যে।
লোকটি দু’হাত দিয়ে স্টেনগান আঁকড়ে ধরেছিল।
আহমদ মুসা এক পা দিয়ে স্টেনগান চাপা দিয়ে অন্য পা দিয়ে প্রচণ্ড এক লাথি মারল লোকটির স্টেনগান ধরা হাতে।
লোকটির থেথলে যাওয়া হাত স্টেনগান ছেড়ে দিল।
আহমদ মুসা দু’হাতে লোকটিকে তুলে দাঁড় করিয়েই প্রচণ্ড এক ঘুষি মারল তার মুখের এক পাশে। সে ছিটকে গিয়ে পড়ল। একেবারে পড়ল গিয়ে রিভলবারের উপর। নতুন প্রাণ পাওয়ার মত সে তুলে নিল রিভলবার। রিভলবার ঘুরাল সে আহমদ মুসার দিকে।
কিন্তু দেখল আহমদ মুসার স্টেনগান আগেই তাকে লক্ষ্য করে হাঁ করে উঠেছে।
আহমদ মুসা লোকটিকে ঘুষি মেরেই পায়ের তলা থেকে তুলে নিয়েছিল স্টেনগান।
লোকটিকে রিভলবার কুড়িয়ে ঘুরতে দেখেই আহমদ মুসা স্টেনগানের ট্রিগার টিপল।
লোকটির ঝাঁঝরা দেহ গড়িয়ে পড়ল ডেকের উপর।
চারিদিকে একবার তাকিয়ে স্টেনগান ফেলে দিল আহমদ মুসা হাত থেকে।
জিভারো, প্রফেসর আরাপাহো এবং ওগলালা এতক্ষণ ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে পাথরের মত নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিল স্বপ্নাতীত এক দৃশ্য।
এবার জিভারো ছুটে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে।
প্রফেসর আরাপাহোও এল। সে আহমদ মুসার মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘ঈশ্বর তমাকে দীর্ঘজীবি করুন বৎস।‘
আর ওদিকে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়ানো ওগলালার স্থির চোখ দু’টি থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, কৃতজ্ঞতার অশ্রু, অবিরামভাবে।
আহমদ মুসা সেদিকে এগুবার জন্যে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল। ‘অশ্রু কেন ওগলালা, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর।’
ওগলালা ছুটল আহমদ মুসার দিকে। ছুটে এসে উপুড় হয়ে মাথা রাখল আহমদ মুসার পায়ে।
আহমদ মুসা তাকে টেনে তুলল ল বলল, ‘বোস, মানুষ আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে সম্মানিত সৃষ্টি। আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে তার মাথা নত হবে না, এটা আল্লাহ চান।’
‘হতে পাড়ে ভাইয়া। কিন্তু মাটির মানুষও অনেক সময় ঈশ্বর হয়ে ওঠেন।’ কান্নায় ভেঙে পড়ল তার কথা।
‘আল্লাহ মাফ করুন। যে মানুষকে তুমি ঈশ্বর বলবে, হতে পাড়ে সে আল্লাহর মাত্র একজন অনুগত বান্দাহ।’
বলে আহমদ মুসা তাকাল জিভারোর দিকে। বলল, ‘জিভারো বোটের ক্রুদের বল, লাশ গুলো নদীতে ফেলে সবগুলো জায়গা ভালও করে ধুয়ে দেবে।’
কথা শেষ করে আহমদ মুসা প্রফেসর আরাপাহোর দিকে চেয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় লাশ ও অস্ত্রগুলো পুলিশের জন্যে রেখে ঝামেলা বাড়ানো ঠিক হবে না।’
‘না, তুমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। পুলিশ আশেপাশে থাকলে দেখা যেত। এখন কোথায় পুলিশ খুঁজে বেড়াব।’
জিভারো আহমদ মুসার নির্দেশ নিয়ে নিচের ডেকে চলে গেল।
আর আহমদ মুসা, প্রফেসর আরাপাহো এবং ওগলালা কেবিনের ভেতরে এসে একটা টেবিল ঘিরে বসল।
ক-মিনিট পর জিভারো এসে প্রবেশ করল। বলল, ‘ওরা কাজে লেগে গেছে। নোঙর তোলা হয়েছে। এখনি বোট চলতে শুরু করবে।’
‘ঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছ। বলতে চেয়েছিলাম এটা। ভুলে গেছি।’
চা এল।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রফেসর আরাপাহো অনেকটা স্বগতোক্তির মত বলল, ‘জীবন রক্ষাকারী এবং জীবন সংহারী দুই আহমদ মুসাকেই আজ দেখলাম।’
‘কোন আহমদ মুসা বড় আব্বা?’ বলল ওগলালা।
তার পিতা প্রফেসর আরাপাহো মুখ খলার আগেই জিভারো বলে উঠল, ‘আব্বা যাকে জীবন সংহারী আহমদ মুসা বলেছেন, সেই আহমদ মুসাই বড়।’
‘তোমার যুক্তি কি বলত।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘খুবই সহজ। প্রথম ঘটনায় একজন বালকের জীবন রক্ষা হয়েছে। তার বেশি কিছু ঐ ঘটনায় নাই। কিন্তু শেষের এই ঘটনায় চলমান পায়ের একটা পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাতজন লোকের প্রাণ সংহার হয়েছে, কিন্তু এর দ্বারা অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে এবং অনেক পরিবার ধ্বংস থেকে রক্ষা পেয়েছে। অন্যায় জুলুম সংহারী আহমদ মুসার এই রুপই বড়।’
‘ধন্যবাদ জিভারো। আমিও তাই মনে করি। ভালো কাজ ভালো, অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিরোধ এর চেয়ে অনেক বেশি মুল্যবান। ভাল কাজের ভাল ফলের যে পরিধি, তার চেয়ে অন্যায় প্রতিরোধের যে ভাল। তার পরিধি অনেক বেশি ব্যাপক।’
প্রফেসর আরাপাহো থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ জনাব, আপনার কথা আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআনেরই প্রতিধ্বনি অনেকটা। আমাদের ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, হত্যা, জুলুমের মত অপরাধের নির্ধারিত শাস্তি বিধানের মধ্যে মানুষের জীবন নিহিত।’
‘তার মানে শাস্তিটা মানুষের জীবনের মত মুল্যবান। শাস্তি না থাকলে মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। তাই কি ?’
‘হ্যাঁ তাই।’
‘তাহলে অনেকে এবং অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড ও কঠোর শাস্তি তুলে দিচ্ছে বা তুলে দেওয়ার কথা বলছে তার কি হবে?’ বলল জিভারো।
‘এটা এক ধরনের চিন্তা বিকৃতি। এই বিকৃতদের কাছে বিচারের খড়গ ভয়ংকর, কিন্তু অপরাধীদের খড়গ যেন একটা স্বাভাবিক ঘটনা।’ আহমদ মুসা বলল।
‘শাস্তি কি মানুষের সুস্থ ও শান্তির জীবন নিশ্চিত করতে পারে?’ জিভারো বলল।
‘আমাদের ধর্মগ্রন্থে এই ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে দু’ধরণের কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এক, ভালো কাজের নির্দেশ দিতে হবে এবং মন্দ কাজ, পাপ, অপরাধ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নির্দেশ ও বিরত রাখার চেষ্টাই কি যথেষ্ট?’ জিভারো বলল।
‘আমাদের ধর্মের বিধান অনুসারে এ দু’টি বাহ্যিক পদক্ষেপের পর্যায়ভুক্ত। আত্মিক ও বিশ্বাসগত কিছু পদক্ষেপ রয়েছে। এই বাহ্যিক ও আত্মিক ব্যবস্থা একত্রে মিলিত হলে তবেই মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা বা অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রিত হয়।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বিশ্বাসগত যে ব্যবস্থার কথা বললে সেটা কি?’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনের মাধ্যমে আমরা যে জীবন দর্শন পেয়েছি, সে জীবন দর্শন হলোঃ মানুষের দুনিয়ার জীবন মৃত্যু পরবর্তী চিরন্তন জীবনের প্রস্তুতি পর্ব মাত্র। দুনিয়ার জীবনে ভাল কাজ করলে পরজীবনে চিরন্তন পুরস্কার পাওয়া যাবে এবং খারাপ কাজ করলে চিরন্তন শাস্তির সম্মুখিন হবে। দুনিয়ার জীবনে মানুষ ছোট-বড় যে কাজই করুক তার ভাল অথবা খারাপ যে কোন একটি ফল রয়েছে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে তা ভোগ করতে হবে। যে মানুষ স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে তার দ্বারা শুধু ভাল কাজই হবে এবং মন্দ কাজ থেকে সে বিরত থাকবে। এই বিশ্বাসগত নিয়ন্ত্রণ মানুষকে সকল পাপ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বিশ্বাস মানুষকে এত পরিশুদ্ধ করতে পারে?’ বলল জিভারো।
‘এটা নিছক কোন বিশ্বাস নয়। মানব জীবনের এটা অনিবার্য বাস্তবতা যা তার অস্তিত্বের মতই সত্য। এই বিশ্বাসের শক্তি জগতের সবচেয়ে বড় শক্তি।’
‘আপনি ভয়ংকর কথা শুনালেন। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ঐ পরিণতি থেকে তো আমরা কিংবা কোন মানুষ তাহলে মুক্ত নয়?’ বলল ওগলালা চোখ কপালে তুলে। ঘটনার পর প্রথম মুখ খুলল ওগলালা। কথা বললেও তার মুখের গাম্ভীর্য ও বিষণ্নতা কাটেনি।
‘না কোন মানুষই মুক্ত নয়।’
‘কিন্তু আমরা তো এ বিশ্বাসের কথা এভাবে জানি না। তাহলে আমাদের কি হবে?’
‘যারা জানে, জানানোর দায়িত্ব তাদের। আর সত্য সন্ধানী বিবেক সত্যের সন্ধান যে কোন ভাবে পাবেই। যেমন আজ আপনারা আমার কাছ থেকে সন্ধান পেলেন।’
‘হাসল প্রফেসর আরাপাহো। বলল, ‘তুমি একজন দক্ষ এবং খাঁটি মিশনারী। এ পরিচয়ে তুমি দেখছি অনেক বড়। তুমি সবশেষে যে কথাটা বললে তার অর্থ হলো তুমি মানুষের অস্তিত্বের মত সত্য যে পথের সন্ধান দিলে তা আমাদের মেনে নেয়া।’
‘হাসল আহমদ মুসাও। বলল, ‘এটা দোষণীয় নয় নিশ্চয়। নিজের জন্যে যা ভাল মনে করা হয়, তা অপরের জন্যে ভাল মনে করাই প্রকৃত কল্যাণকামীতার লক্ষণ।’
‘ধন্যবাদ বৎস। তোমার সাথে দেখা হওয়ায় ঈশ্বরের শুকরিয়া আদায় করছি। মনে হচ্ছে, তোমার সংস্পর্শে আমরা নতুন মানুষে পরিণত হচ্ছি।’
‘তাও বটে।’ বলল প্রফেসর আরাপাহো।
‘এখন এ পর্যন্তই। চলুন ওরা কতটা কি করল দেখা যাক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না একটু বসুন। আমার একটা কথা। এই কিছুক্ষণ আগের কঠিন বিপদের সময় আপনার মুখ আমি সব সময় নির্ভয় ও উদ্বেগহীন দেখেছি এবং আপনার ঠোঁটে হাসিও দেখেছি। আপনি কি একটুকুও ভয় পাননি?’ বলল ওগলালা।
‘আহমদ মুসার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘ভাল বা মন্দ করার একমাত্র মালিক আল্লাহ, জীবন ও মৃত্যুর ফায়সালা শুধু আল্লাহই করেন, এই বিশ্বাস থাকলে কোন মানুষকে ভয় করার কোন অবকাশ থাকে না, কোন বিপদেই তখন ভয় আসে না।’
‘কিন্তু আপনি যদি পরাজিত হতেন, ওরা ছিল সাত অস্ত্রধারী।’ বলল জিভারো।
‘ভাবতাম ওরা জয়ী হবার মত তাই আল্লাহ তাদের জয় দিয়েছেন। তবে আমিও জয়ী হবার চেষ্টা করতাম তারপর।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ওরা সাতজন মরেছে, মরেও তো যেতে পারতেন আপনি?’ জিভারোই আবার বলল।
‘হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘আমার চেষ্টা জয়ের জন্যে, কিন্তু মৃত্যুর জন্যেও আমি সব সময় পস্তুত।’
প্রফেসর আরাপাহো, জিভারো এবং ওগলালা স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে।
‘আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও তারা কেউ কথা বললো না, বলতে পারলো না।
কিছুক্ষণ পর ওগলালা প্রশ্ন করল, ‘আপনার দেশ কোথায়? আপনার বাড়ি কোথায়? আপনার কে আছে?’ প্রশ্নগুলোর সাথে সাথে রাজ্যের মমতা ঝরে পড়ল ওগলালার চোখে-মুখে।
আহমদ মুসা ম্লান হাসল। বলল, ‘তুমি কঠিন প্রশ্ন করেছ ওগলালা।’
বলে একটু থামল। তারপর বলল, ‘আমি জন্মগ্রহন করেছি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে, যাকে পূর্ব তুর্কিস্তানও বলা হয়। কিন্তু সেটা এখন আমার দেশ নেই। আমাকে অনেক দেশ তাদের নাগরিকত্ব দিয়েছে। কোনটাকে আমার দেশ বলব? আমি এ নিয়ে কোন সময় ভাবিনি।’
আবার থামল আহমদ মুসা। হাসল আবারও। বলল, ‘কে আছে’ বলতে নিশ্চয় রক্তের সম্পর্কের কাউকে বুঝিয়েছ। তেমন আমার কউ নেই। আমার আব্বা, আম্মা, ছোট ভাই সবাই নিহত হয়েছে সেই জিনজিয়াং-এ। আমি বেঁচে ছিলাম উদ্বাস্তু হয়ে। রক্তের সম্পর্কের বাইরে সবচেয়ে ঘনিষ্টতম হলেন স্ত্রী। আমি ক’মাস আগে বিয়ে করেছি। তিনি আছেন।’ থামল আহমদ মুসা।
সলজ্জ একটা রক্তিমাভা ফুটে উঠেছে ওগলালার মুখে। তার সাথে প্রবল উৎসুক্য। বলল, ‘মাত্র ক’মাস আগে বিয়ে? তিনি কোথায়? দেশ না থাকলে তিনি কোথায় আছেন? তিনি কি আমেরিকা এসেছেন?’
‘আমাদের নবীর দেশ সৌদি আরবের অন্যতম পবিত্র নগরী ‘মদিনা’ শরীফে তাঁকে রেখে এসেছি।’ আহমদ মুসা থামল।
তৎক্ষণাৎ কেউ কথা বলল না।
সবার চোখে-মুখে একটা বিস্ময় ও বেদনার চিহ্ন।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তিনি কিছু ঘটাননি। কিন্তু আপনার কিছু ঘটলে উনি কি জানতে পারতেন? কি হত তাঁর? কি করতেন তিনি?’ নরম কম্পিত গলায় বলল ওগলালা।
আহমদ মুসার ঠোঁটে এক টুকরো স্বচ্ছ হাসি। বলল, ‘আমি সানসালভাদরে হোয়াইট ঈগলের হাতে ধরা পড়ার আগের দিন তাঁর সাথে কথা বলেছি টেলিফোনে। আবার সুযোগ পেলে বলব।’
‘আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না জনাব।’ ব্যথিত-ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল ওগলালা।
‘উত্তর আমি জানি না ওগলালা। আমার অভিভাবক যিনি, আমার স্ত্রীরও অভিভাবক যিনি সেই আল্লাহর উপর তাঁর ও আমার দু’জনেরই ভরসা।’ গোটা আলোচনায় এই প্রথমবারের মত আহমদ মুসার কণ্ঠ একটু কাঁপল, একটু ভারিও শুনাল।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।
বলল, ‘চলুন ওদিকটা দেখা যাক।’
সবাই উঠল।
প্রফেসর আরাপাহো উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আহমদ মুসা, তোমার শক্তি ও সাহসের উৎস কি তা আজ দেখলাম, যে লোক ঈশ্বরের উপর ভরসা করে জীবন-মৃত্যুর সব প্রশ্ন পেছনে ফেলে উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে অগ্রসর হতে পারে, তার অসাধ্য কিছুই থাকবে না, সে অজেয় হবে, এটাই স্বাভাবিক। তোমাকে অভিবাদন নয় আহমদ মুসা, তোমার বিশ্বাসকে, তোমার মহান নবীকে, যাঁর শিক্ষা তুমি অনুসরণ কর এবং তোমার আল্লাহকে, যাঁর বিধান তুমি পালন কর, আমি অভিবাদন জানাচ্ছি এবং তোমার বিশ্বাসের সাথী হবার অংগিকার করছি।’
বলে আহমদ মুসার দিকে হাত বাড়াল প্রফেসর আরাপাহো।
আহমদ মুসা আনন্দে লুফে নিল প্রফেসর আরাপাহোর হাত।
এক হাত আরেক হাতকে বাড়িয়ে ধরল নিবিড়ভাবে। যন্ত্রচালিতের মতো কোন অমোঘ আকর্ষণে ওগলালা এবং জিভারোর হাতও এসে যুক্ত হলো দু’টি হাতের সাথে।
এ যেন চার হাতের মিলন নয়, বিশ্বাসী চার হৃদয়ের এক অপরূপ মিলন।
বোট ধুয়ে-মুছে সাফ করা হয়েছে।
কিছুক্ষণ আগের রক্তাক্ত ঘটনার কোন চিহ্নই বর্তমান নেই।
জিভারো নিচের ডেকে নেমে গেছে কোন কাজে। প্রফেসর আরাপাহো তার কক্ষে বিশ্রাম নিতে গেছে।
আহমদ মুসা তার দু’হাতের কনুই বোটের রেলিং-এ রেখে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে তাকিয়ে আছে সামনে ইন্ডিয়ানার অবারিত সবুজ সৌন্দর্যের দিকে।
ওগলালা আস্তে আস্তে এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। দু’হাতের কনুই রেলিং-এ রেখে আহমদ মুসার মতই সামনে ঝুঁকে পড়ল এবং তাকাল আহমদ মুসার দিকে। তারপর মুখ ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার বিশ্বাসের সাথী হবার অংগিকার করেছি। কিন্তু আপনি যে কষ্ট দিয়েছেন তা ভুলে যাইনি। আপনি নিষ্ঠুর! নিষ্ঠুর! নিষ্ঠুর!’
আহমদ মুসা কপাল কুঞ্চিত করে ওগলালা দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বুঝলাম না। নিষ্ঠুরতার কি দেখলে?’
‘আপনি সবার প্রতি হয়তো সুবিচার করছেন, কিন্তু অবিচার করছেন ভাবীর প্রতি। এটা নিষ্ঠুরতা।’
‘কিন্তু তোমার ভাবীর সাথে তুমি কথা বলনি। তাঁর কাছ থেকে কিছু শোননি।’
‘শোনার কি প্রয়োজন আছে? আমি মেয়ে নই? কোন মেয়েই তার স্বামী কোন বিদেশ-বিভূয়ে অজানার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে তা বরদাশত করতে পারে না।’
‘তোমার কথা ঠিক। কিন্তু তোমার ভাবী শুধু তো নারী নয়, তিনি আমার বিশ্বাস ও কর্মের সাথী। আমার যে কাজ সেটা তারও কাজ এবং সে কারণেই তিনি আমাকে উৎসাহের সাথে বিদায় দিতে পারেন।’
‘এটা যুক্তির কথা। এ যুক্তির বাইরে মনের একটা ভিন্ন অবস্থান আছে।’
‘আছে। কিন্তু তারপরও একজন মেয়ে তার হাতের বিয়ের মেহেদী না মুছতেই স্বামীকে যুদ্ধে পাঠায় এবং স্বামীকে আর ফিরে পায় না-এ দৃষ্টান্তও আছে।’
‘এবং তার শেষহীন ও সীমাহীন বুক ফাটা কান্নার দৃষ্টান্তও আছে। আমি নারী, আমি এ অসহায় নারীর কথাই বলছি।’
‘ঠিক বলেছ। কিন্তু তুমি, আমি এবং তোমার ভাবী সংসারের এ বাস্তবতাকে কি অস্বীকার করতে পারব?’
‘আমি জানি না। কিন্তু নারীর অশ্রুর মূল্য পুরুষরা দেয় না, এটাই ঠিক।’
বলেই ছুটে পালাল ওগলালা। তার শেষ কথাটা ছিল কান্নায় ভারি।
আহমদ মুসা ডাকল না তাকে।
ওগলালার কান্না ভরা কণ্ঠ আহমদ মুসাকে মনে করিয়ে দিল সান ওয়াকারের কথা। মনে পড়ল মেরী রোজ এর কথাও। বেদনায় ভরে গেল আহমদ মুসার মন। ওগলালার হৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে সার ওয়াকারকে নিয়ে তার প্রতিকার কিসে!
৪
কাহোকিয়ার ফেডারেল রেস্টহাউজ।
মিঃ ডেভিড তার কক্ষের দরজা খুলে সুন্দর বেড এবং সাজানো-গোছানো ঘর দেখে খুব খুশী হলো।
হাতের ব্যাগটা সে মেঝের উপর ছুড়ে দিয়ে বিছানার উপর ঝাপিয়ে পড়ল।
মিঃ ডেভিড আসলে মিঃ ডেভিড গোল্ড ওয়াটার। হোয়াইট ঈগলের আমেরিকান প্রধান। ডেভিড ছদ্মনামে সে ফেডারেল রেস্টহাউজে উঠেছে।
ফেডারেল রেস্টহাউজ রেড ইন্ডিয়ান রিজার্ভ এলাকা কাহোকিয়ার ফেডারেল কমিশনারের অফিস কর্তৃক পরিচালিত রেস্টহাউজ। ভ্রমণ বা অন্য কোন কাজে ভিআইপি নাগরিক যারা কাহোকিয়া আসেন, তারা ইচ্ছা করলে থাকতে পারেন এখানে। কিন্তু এই মানের হোটেল থেকে চারগুণ বেশি ভাড়া ও খাবারের চার্জ দিতে হয় এখানে। তবু নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে উল্লেখযোগ্য সবাই এখানে উঠতে চায়। স্ট্যাটাস অনুসারে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই রেস্ট হাউজে থাকতে দেয়া হয়। যেহেতু রেস্টহাউজটা ফেডারেল কমিশনের অফিস-এর অংশ, তাই এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ফেডারেল কমিশনারের হাতে।
রেড ইন্ডিয়ানদের প্রত্যেক রিজার্ভ এলাকায় একটি করে ফেডারেল কমিশন আছে। ফেডারেল কমিশন রেড ইন্ডিয়ান রিজার্ভ এলাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থ দেখা ছাড়াও সেখানকার প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার আপিলেই প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে।
ডেভিড গোল্ড ওয়াটার জেনারেল আইজ্যাক শ্যানরণসহ তার আরও চারজন নিরাপত্তা কর্মীকে নিয়ে সে এই রেস্টহাউজে উঠেছে। জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ আইজ্যাক ছদ্মনামে রেস্টহাউজে পরিচিত হয়েছেন।
তারা ওয়াশিংটনের সেক্রেটারী অব স্টেটের অফিস থেকে পরিচিতি কার্ড নিয়ে এসেছে তাই সম্মানিত মেহমান হিসেবে জায়গা পেয়েছে রেস্টহাউজে।
ডেভিড গোল্ড ওয়াটার নিজেকে বেশ ক্লান্ত মনে করছে। ওয়াশিংটন থেকে বিমানে এসেছে শিকাগো। সংগে সংগেই সেখান থেকে হেলিকপ্টারে কাহোকিয়া।
গোল্ড ওয়াটারের চোখ ধরে এসেছিল। তার দরজায় নক হলো।
চোখ খুলল সে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
দরজায় মাঝ বয়সি এক শ্বেতাংগ দাঁড়িয়ে। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমি এ্যালেন ট্যালন্ট। এখানকার ফেডারেল কমিশনার। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। শুনলাম, স্টেট ডিপার্টমেন্টের মেহমান এসেছেন। দেখা করতে এলাম।’
‘আমি ডেভিড। আসুন।’ বলে ডেভিড গোল্ড ওয়াটার ট্যালন্টকে নিয়ে এসে সোফায় বসাল।
নিজে বসতে বসতে ডেভিড বলল, ‘ঠিক স্টেট ডিপার্টমেন্টের মেহমান নয়। আমার সাথে একজন সম্মানিত বিদেশীও আছেন, মিঃ আইজ্যাক। পাশের রুমেই উনি আছেন। সব মিলিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট আমাদের একটা পরিচিতি পত্র দিয়েছে।’
‘ঐ একই হলো।’ বলে একটু থামল ট্যালন্ট। তারপর আবার শুরু করল, ‘আপনারা কতদিন থাকছেন? কি উদ্দেশ্যে এসেছেন? আমি কি করতে পারি আপনাদের জন্যে?’
‘থাকার ঠিক নেই যতদিন ভাল লাগবে থাকব। উদ্দেশ্য কাহোকিয়া দেখা। রেড ইন্ডিয়ানদের এলাকা, কোন চোর-ছ্যাচ্ছর হাইজ্যাকারের ফাদে না পড়ি, এটুকু আপনি দেখবেন।’
‘অবশ্যই কাহোকিয়া ভাল জায়গা। এখানকার স্থানীয়রাও ভাল। তবে খুবই স্বতন্ত্রমনা এবং মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন। আমি মনে করি কাহোকিয়া সমঝদারদের জন্যে একটা স্বর্গভূমি। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস এখানে চোখে দেখা যায়। মিসরের পিরামিড এলাকা পর্যটকদের স্বর্গভূমি বলা হয়, কিন্তু কাহোকিয়া তারচেয়ে কোন অংশে কম নয়। বরং এখানকার কাহোকিয়ার মাটির পিরামিডগুলো মিসরের-গুলোরচেয়েও বড় এবং সংখ্যাতেও বেশি। সুতরাং দেখার অনেক কিছু পাবেন।’
ট্যালন্ট থামতেই আবার দরজায় নক হলো।
‘আসুন।’ দরজার দিকে তাকিয়ে বলল ডেভিড।
ঘরে প্রবেশ করল রেস্টহাউজ অফিসের একজন স্টাফ। হাতে তার একটা রেজিস্টার। স্টাফটি এক তরুণ রেড ইন্ডিয়ান।
‘প্রাথমিক কাজটা তোমাদের এখনও সারা হয়নি? ঠিক আছে, সেরে নাও।’ এ কথাগুলো ট্যালন্ট রেড ইন্ডিয়ান তরুণকে লক্ষ্য করে বলে মুখ ফিরাল ডেভিড গোল্ড ওয়াটারের দিকে। বলল, মিঃ ডেভিড, এখন আসি। পরে কথা হবে। সময় করে একবার চা খান আমার অফিসে।’
‘অবশ্যই।’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে ডেভিড গোল্ড ওয়াটার হ্যান্ডসেক করল ট্যালন্টের সাথে।
ট্যালন্ট চলে গেল।
রেড ইন্ডিয়ান তরুণটি তার রেজিস্টার হাতে তখনও দাঁড়িয়েছিল।
‘তোমার নাম কি? বস।’
তরুণটি বসল। বলল, ‘আমি নাভাজো।’
কথা বলার মত একজন রেড ইন্ডিয়ান তরুণকে দেখে খুশিই হলো ডেভিড গোল্ড ওয়াটার। কারণ সে জানে, রেড ইন্ডিয়ান চক্রে প্রবেশ করতে হলে, ঈগল সান ওয়াকার এবং তাকে সাহায্যকারী আহমদ মুসার খোঁজ পেতে হলে রেড ইন্ডিয়ানদের সাহায্য দরকার। গোল্ড ওয়াটার এবং জেনারেল শ্যারণের দৃঢ় বিশ্বাস, সান ওয়াকার অবশ্যই ওয়াশিংটন ফেরেনি, তার নিরাপত্তার জন্যে আহমদ মুসা নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে এসেছে কাহোকিয়াতে কিংবা অপর কোন রেড ইন্ডিয়ান রিজার্ভ এলাকায়। কাহোকিয়াকেই তারা প্রথম সন্দেহ করেছে। তাই এসেছে তারা প্রথমে কাহোকিয়াতেই।
‘বল নাভোজো, তোমাকে কি সাহায্য করতে পারি।’ বলল গোল্ড ওয়াটার খুবই আন্তরিক কণ্ঠে।
‘ধন্যবাদ স্যার। আমাদের রেজিস্টার পূরণের জন্যে কতকগুলো রুটিন ইনফরমেশন।’
‘বল সে সব কি?’
‘পূর্ণ নাম, ঠিকানা, বয়স, কতদিন থাকবেন, সফরের উদ্দেশ্য, খাবেন রেস্টহাউজে কিনা, বেড়াবার সময় ‘গাইড’ বা সিকুরিটি দরকার কিনা, ইত্যাদি।’
ডেভিড গোল্ড ওয়াটার ডিকটেট করল এবং নাভাজো লিখল তার রেজিস্টারে।
কতদিন থাকবে সে ব্যাপারে গোল্ড ওয়াটার বলল, ‘যতদিন ভাল লাগবে, ততদিন থাকব। যে মুহূর্তে মনে করব চলে যাব, সে মুহূর্তেই চলে যাব। রেস্টহাউজেই খাবার ব্যবস্থা থাকবে, তবে বাইরেও কখনও খেতে পারি। প্রতিদিনের পেমেন্ট প্রতিদিনই করব।’
আর সফরের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে বলল, ‘কাহোকিয়ার কিছু লোকের সাথে পরিচয় ছিল তাদের সাথে দেখা সাক্ষাত এবং কাহোকিয়াকে দেখা ও জানা।’
গাইড ও সিকুরিটির লোক নেয়ার ব্যাপারে বলল, ‘লোক পছন্দ করে নিয়োগ দিয়ে রাখতে চাই। দরকার হলে সাথে নেব।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে নোট শেষ করে উঠে দাঁড়াচ্ছিল নাভাজো।
‘একটু বস নাভাজো।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
নাভাজো বসল
‘তোমার বাড়ি কাহোকিয়াতেই না?’ জিজ্ঞেস করল গোল্ড ওয়াটার।
‘জ্বি হ্যা।’
‘ওল্ড কাহোকিয়াতে না নিউ কাহোকিয়াতে?’
‘ওল্ড অংশে।’
‘তাহলে তোমরা বোধহয় খুব পুরনো বাসিন্দা?’
‘জ্বি হ্যা।’
‘তোমার লেখাপড়া?’
‘ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় থেকে গ্রাজুয়েশন।’
‘বাইরের মানে স্টেটের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ যায় না।?’
‘অনেকেই যায়।’
‘বল, ওয়াশিংটনের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ আছে?’
গোল্ড ওয়াটারের এসব প্রশ্নের টার্গেট সান ওয়াকারের প্রসঙ্গ সামনে আনা এবং তার সম্পর্কে জানা। সান ওয়াকারও নিশ্চয় ওল্ড কাহোকিয়ার বাসিন্দা হবে। শিক্ষিত নাভাজো নিশ্চয় তাকে চিনবে।
গোল্ড ওয়াটারের প্রশ্নে নাভাজো একটু ভাবল। তার মুখটাকে কিছুটা ম্লান দেখাল। বলল, ‘তিনজনের কথা আমার মনে পড়ছে। আমার মনে হয় শুধু এ তিনজনই সেখানে পড়ে।’
‘বা! তিনজন! কম নয়তো। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে জান?’
‘জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে।’
‘সবাই?’
‘হ্যা।’
‘নিশ্চয় খুব ভাল ছাত্র ওরা। স্কলারশীপে না নিজ খরচে ওরা পড়ছে?’
‘শুধু একজন ঈগল সান ওয়াকার স্কলারশীপ পেয়েছে। সে একজন ছাত্র-বিজ্ঞানী।’
গোল্ড ওয়াটারের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন সে সাত রাজার ধন কুড়িয়ে পেয়েছে।
পরক্ষণেই মুখে কৃত্রিম বিস্ময় টেনে বলল, ‘ঈগল সান ওয়াকারের বাড়ি এখানে? কাহোকিয়াতে? তার কথা শুনেছি, পড়েছি কাগজে। বিজ্ঞানে কৃতিত্বের জন্যে অনেক গোল্ড মেডেল পেয়েছে।’
‘জ্বি হ্যা, ওর বাড়ি এই কাহোকিয়াতেই।’
‘ওল্ড না নিউ কাহোকিয়াতে?’
‘ওল্ড কাহোকিয়ায়।’
‘এখন তো সে বিশ্ববিদ্যালয়ে না?’
মুখ ম্লান হয়ে উঠল নাভাজোর। বলল, ‘তার এখন খুব বিপদ। তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। ছাড়া পেয়ে সে লুকিয়ে আছে।’
‘বল কি নাভাজো? এ রকম খবর তো শুনিনি! তাকে কিডন্যাপ করার কে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে? সে কোথায়? পুলিশ নিশ্চয় কিছু করছে?’
‘সে কাহোকিয়াতেই পালিয়ে এসেছে। পুলিশ তার জন্যে কিছুই করেনি শুনেলাম।’
সাফল্যের আনন্দে চোখ দু’টি আনন্দে চিক চিক করে উঠল গোল্ড ওয়াটারের।
কিন্তু পরক্ষণেই চোখে-মুখে কৃত্রিম সমবেদনার বান ডাকিয়ে বলল, ‘আহা বেচারা, তার জন্যে তো কিছু করতে হবে। পুলিশ ও সরকারের কিছু বড় বড় লোকের সাথে আমার পরিচয় আছে। আমি অবশ্যই কিছু করতে পারবো।’
‘তাহলে সত্যিই সে উপকৃত হয়।’
‘তার সাথে দেখা করিয়ে দিতে পার? কিংবা বাড়ির ঠিকানা দিলেও চলবে।’
‘সে আসার পর আমার সাথেও দেখা হয়নি। নিজের বাড়িতে নয়, কোন এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকে শুনেছি। একটু খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাব।’
‘ধন্যবাদ নাভাজো। তার কথা শুনে সত্যিই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। দেখ তুমি কত তাড়াতাড়ি তার সাথে দেখা করিয়ে দিতে পার।’
‘অবশ্যই আমি তাড়াতাড়ি চেষ্টা করব স্যার। সেও নিশ্চয় খুব খুশি হবে।’
কথা শেষ করেই আবার সে বলল, ‘তাহলে উঠি স্যার এখন?’
‘এস। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।’
‘ধন্যবাদ স্যার। বাই।’ বলে উঠে দাঁড়াল এবং বেরিয়ে গেল ঘর থেকে নাভাজো।
নাভাজো বেরিয়ে যেতেই গোল্ড ওয়াটার টেলিফোন তুলে জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণকে বলল, ‘এখনই চলে এস আমার ঘরে, মহা খবর আছে। টেলিফোনে বলা যাবে না।’
মিনিট খানেকের মধ্যেই ঘরে এসে প্রবেশ করল আইজ্যাক শ্যারণ।
সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘কেবল সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বিছানায় গা দিয়েছি। খুব ক্লান্তি লাগছে। বল তোমার মহাখবর।’
‘সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে আইজ্যাক খবরটা শোনার পর। দেখ, তুমি গোছ-গাছ করে এতটা সময় কাটিয়েছ। কিন্তু আমি এক মিনিটও নষ্ট না করে আসল আজে লেগে গেছি। ইতিমধ্যেই আমি আবিস্কার করে ফেলেছি, ঈগল সান ওয়াকার কাহোকিয়াতে আছে।’
কথাটা শুনতেই জেনারেল আইজ্যাক লাফিয়ে উঠল শোয়া থেকে এবং গোল্ড ওয়াটারের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ব্রাভো, ব্রাভো, সত্যিই তুমি কাজের লোক গোল্ড ওয়াটার। তুমি যাদু জান নাকি?’
‘যাদু নয়, বুদ্ধি বলে খবরটা বের করেছি।’ বলে গোল্ড ওয়াটার নাভাজোর সাথে তার সব কথার রিপোর্ট দিল জেনারেল আইজ্যাককে।
জেনারেল আইজ্যাক শোনার পর আনন্দের আতিশয্যে আবার হ্যান্ডশেক করল গোল্ড ওয়াটারের সাথে এবং বলল, ‘বড় শয়তানের খোঁজ পেয়েছ?’
‘আহমদ মুসার?’
‘হ্যা।’
‘জিজ্ঞেস করলে ওর মনে কোন সন্দেহ জাগতে পারে ভেবে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তবে কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি সান ওয়াকারের সাথে তার আসা স্বাভাবিক।’
‘তোমার কথা ঠিক হোক গোল্ড ওয়াটার। আমি আমার কথা রাখব। তার মূল্যটা আমরা বাড়িয়ে দেব।’
‘ধন্যবাদ আইজ্যাক শ্যারণ। এখন আমাদের প্রথম কাজ হলো সান ওয়াকার কোথায় থাকে তা জেনে নেয়া এবং গোপনে তার উপর চোখ রাখা।’
‘ঠিক বলেছ গোল্ড ওয়াটার, আমরা এসেছি তা ঘূর্ণাক্ষরেও যেন সান ওয়াকার টের না পায়।’
‘অবশ্যই। আমি নাভাজোকে বলেছি সান ওয়াকারের সাথে দেখা করার কথা। এটা নাভাজোকে আমার আগ্রহ ও সমবেদনা দেখাবার জন্যে। আমি কৌশলে জানব সান ওয়াকার কোথায় থাকে সে ঠিকানা। কাজ ও ব্যস্ততার কথা বলে দেখা করার বিষয়টাকে এড়িয়ে যাব।’
‘কিন্তু সেও তো বলতে পারে সান ওয়াকারকে দেখা করার জন্যে।’
‘তাও বলতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, সান ওয়াকার যেহেতু লুকিয়ে থাকছে, তাই সরকারী রেস্টহাউজে আসার মত কাজ সে করবে না। তবু আমরা বিষয়টার দিকে লক্ষ্য রাখব।’
‘সান ওয়াকারকে পাহারা দিয়ে খুঁজতে হবে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসাকে পাওয়ার পর এক আঘাতেই ওদের দু’জনকেই জালে পুরতে হবে।’
‘অবশ্যই। এখন মুখ্য কাজই হলো আহমদ মুসার সন্ধান করা।’
‘আরেকটা কথা গোল্ড ওয়াটার। নাভাজো আমাদেরকে সহযোগিতা করবে, এটা ধরে নিয়েও আমি মনে করি নাভাজোর উপর গোপনে আমাদের চোখ রাখতে হবে। তার বাড়ির ঠিকানাসহ সে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে দেখা করছে তা আমাদের সংগ্রহ করতে হবে। এর দ্বারা সান ওয়াকার ও আহমদ মুসাকে সে বলার বা দেখার আগেই আমরা তাদের পেয়ে যেতে পারি।’
আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল গোল্ড ওয়াটারের। বলল, ‘তুমি ঠিক বুদ্ধি বের করেছ জেনারেল আইজ্যাক। তোমাকে ধন্যবাদ।’
‘আরও একটা কথা গোল্ড ওয়াটার। তোমাদের সেই মেরী রোজও সান ওয়াকারের সাথে থাকতে পারে। সেটাও যেন মনে রাখে তোমাদের লোকে অনুসন্ধানের সময়।’
‘ধন্যবাদ আইজ্যাক। মেরী রোজ চোখে পড়া অর্থ সান ওয়াকারকে পেয়ে যাওয়া, যদি সে সান ওয়াকারের সাথে এসে থাকে।’
জেনারেল আইজ্যাক কিছু বলতে যাচ্ছিল। দরজায় নক হলো।
জেনারেল আইজ্যাক কথা বন্ধ করে তাকাল গোল্ড ওয়াটারের দিকে।
ডেভিড গোল্ড ওয়াটার উঠে গিয়ে দরজা খুলল। দেখল, একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে। এইভাবে আকস্মিক পুলিশকে দেখে মনে মনে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিল গোল্ড ওয়াটার। চোখে সম্ভবত তার কিছুটা প্রকাশ ঘটেছিল।
পুলিশ অফিসারের ঠোঁটের কোণায় এক টুকরো হাসি ফেুটে উঠেছিল মুহূর্তের জন্যে। বলল, ‘কমিশনার সাহেব পাঠালেন আমাকে আপনার সাথে পরিচিত হবার জন্যে এবং একথা জানাতে যে, প্রয়োজনীয় যে কোন সাহায্যের জন্যে আমরা প্রস্তুত আছি।’
‘অনেক ধন্যবাদ। আসুন বসুন।’ বলে গোল্ড ওয়াটার একপাশে সরে গিয়ে তাকে ভেতরে প্রবেশের জন্যে আহ্বান জানাল।
পুলিশ অফিসারকে নিয়ে গোল্ড ওয়াটার এসে বসাল সোফায়।
মনে মনে খুশীই হলো গোল্ড ওয়াটার। পুলিশ অফিসার রেড ইন্ডিয়ান হওয়ায় তার সাথে পরিচয় খুবই জরুরী মনে করল সে। কথায় কথায় সান ওয়াকারের প্রসঙ্গ তুলে তার সম্পর্কে এদের মনোভাবও জানা যাবে।
গোল্ড ওয়াটার সোফায় বসেই বলল পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে, ‘খুব খুশী হয়েছি আপনি আসায়। আমরা এখানে নতুন, কিছু জানাও যাবে আপনার কাছ থেকে।’
‘কিছু মাটির পিরামিড এবং কিছু ঐতিহাসিক বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া তেমন কিছু জানা, দেখার নেই কাহোকিয়াতে।’
‘কাহোকিয়ার আকর্ষণ তো এগুলোই।’ বলে একটু থেমেই গোল্ড ওয়াটার আবার বলল, ‘এখানকার আইন-শৃঙ্খলা কেমন?’
‘বেশ ভাল। মানে খুবই ভাল বলা যায়। সাত দিনেও একটা মামলা আসে না। আমরা অলস হয়ে গেলাম স্যার।’
‘খুবই সুখবর। নিশ্চিন্তে বেড়ানো যাবে। আচ্ছা একটা খবর বলুন তো, শুনলাম বিখ্যাত ছাত্র-বিজ্ঞানী ঈগল সান ওয়াকার, যে কিডন্যাপ হয়েছিল, তার বাড়ি নাকি এই কাহোকিয়াতে?’ জিজ্ঞাসা করল গোল্ড ওয়াটার।
সান ওয়াকারের নাম শুনতেই মুখটা ম্লান হয়ে গেল পুলিশ অফিসারটির। বলল, ‘জি, তার বাড়ি এই কাহোকিয়াতে।’
‘কাহোকিয়ার জন্যে তো এটা গৌরব।’ বলল গোল্ড ওয়াটার।
‘গৌরব অবশ্যই। কিন্তু গৌরব সূর্য বোধহয় অস্তমিত হয়ে যাচ্ছে! সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে না, পড়া শুনা নেই। পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে এখন।’
‘দুর্ভাগ্য আমাদের। সে এখন কোথায়?’
‘কাহোকিয়াতেই সম্ভবত। একদিন তার সাথে দেখা হয়েছিল। সে বাড়িতে থাকে না।’
‘কেন আপনারা তার উপর চোখ রাখেন না তার নিরাপত্তার জন্যে?’
‘সে পুলিশকে বিশ্বাস করে না। সে মনে করে তার কিডন্যাপ-কারীদের পুলিশ চেনে, কিন্তু তাকে মুক্ত করার কোনই ব্যবস্থা করেনি।’
‘আপনাকেও বিশ্বাস করে না?’
‘না। মনে করে আমি একজন আদেশ পালনকারী চাকুরে।’
‘কিন্তু আপনাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। তার অলক্ষ্যেই তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা আপনারা করতে পারেন।’
‘সে রকম কিছু করলে তার নজরে পড়বেই এবং সে ক্ষেত্রে সন্দেহ করে সে কাহোকিয়া ছেড়েই চলে যেতে পারে।’
‘সে কি এখন কাহোকিয়াতেই? খুব ইচ্ছা আমার বেচারার সাথে দেখা করার।’
‘কয়দিনের খবর আমি জানি না।’
‘নিশ্চয় কাহোকিয়াতেই আছে।’
‘খবর জোগাড় করতে পারলে আমি জানাব আপনাকে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ধন্যবাদ স্যার। আমার আর কিছু করণীয় আছে?’
‘ধন্যবাদ। এখন নেই। দরকার হলে বলব।’
‘আপনার কাহোকিয়া সফর সুন্দর হোক। বাই।’ বলে বেরিয়ে গেল পুলিশ অফিসার।
পুলিশ অফিসার বেরিয়ে যেতেই জেনারেল আইজ্যাক বলল, ‘কাহোকিয়াতে আসার পর দেখছি সব কিছুই আমাদের পক্ষে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে লক্ষ্য অর্জন আমাদের হাতে মুঠোয়।’
‘যদি আহমদ মুসা কাহোকিয়াতে থাকে।’
‘তুমি কি মনে কর?’
‘আমার চেয়ে আহমদ মুসাকে তুমিই ভাল জান। সুতরাং তুমিই বলতে পার তার গতি-বিধির ধরণ সম্পর্কে।’
‘সে সব সময় নতুন। তাই তাঁর সম্পর্কে আগাম কিছু বলা মুস্কিল।’ বলল জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ মুখ ম্লান করে।
‘তবে আমি বলতে পারি, সান ওয়াকারকে নিরাপদে কাহোকিয়াতে পৌঁছানো এবং যেহেতু সে আমেরিকায় নতুন তাই ঐতিহাসিক কাহোকিয়া দেখার এটা তার সুযোগ, এই দুই কারণে অবশ্যই সে কাহোকিয়াতে এসেছে।
‘তোমার কথা সত্যি হোক।’ বলে তার ঘরে ফেরার জন্যে জেনারেল আইজ্যাক শ্যারণ উঠে দাঁড়াল।
গোল্ড ওয়াটারও উঠল। এগুলো বিছানার দিকে অর্ধ সমাপ্ত বিশ্রাম সমাপ্ত করার জন্যে।
ওল্ড কাহোকিয়ার একটা সাধারণ পুরাতন বাড়ি।
বাড়ির বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়ার গাড়ি।
বাড়িটা সান ওয়াকারের খালার। সান ওয়াকার কাহোকিয়াতে ফেরার পর নিজ বাড়িতে না থেকে এখানেই থাকছে।
সান ওয়াকার কিছু ব্যাগ-ব্যাগেজ এনে গাড়িতে তুলল। তারপর বাড়ির ভিতরে ফিরে গিয়ে ড্রইং রুমের সোফায় বসতে বসতে হাঁক দিল মেরী রোজ, সুসান তোমরা এস।
পরক্ষণেই মেরী রোজ এসে সান ওয়াকারের পাশে সোফায় বসল। তার মুখ ভার। বলল, ‘সান তুমি আমাকে এভাবে জোর করে পাঠিয়ে দিচ্ছ কেন?’
‘বলেছি তো, এভাবে তোমার থাকাটা তোমার আব্বা, তোমার পরিবার ভালভাবে নেবেন না।’
‘আমি তো আম্মাকে টেলিফোনে বলেছি, হঠাৎ করে একটা প্রোগ্রামে শামলি হয়ে কাহোকিয়া এসেছি।’
‘তারপরও কয়েকদিন পার হয়ে গেছে।’
‘তাতে কি?’
হাসল সান ওয়াকার। বলল, ‘তুমি ভুলে যাচ্ছে কেন তুমি দেশের প্রধান বিচারপতির কন্যা। দূরে কোথাও পিকনিকে যাবার অনুমতিও যেখানে তোমার পরিবার দেয় না, সেখানে এই আসাটাকে তাঁরা স্বাভাবিকভাবে নেবেন?’
একটু থামল সান ওয়াকার। গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, ‘তুমি কোনভাবে তোমার পরিবার বা কারও কাছে ছোট হও আমি তা চাই না। আবার সেই ছোটটা যদি আমার কারণে হও, তাহলে ভীষণ কষ্ট লাগবে আমার। নিশ্চয় আমাকে তুমি কষ্ট দিতে চাইবে না।’
মেরী রোজ কিছু বলল না। মুখ নিচু করে চুপ করে থাকল।
ড্রইং রুমে প্রবেশ করল শিলা সুসান। বলল, ‘সবাই বসে কেন? চল মেরী রোজ।’ বলে মেরী রোজ-এর দিকে চেয়ে মুখ টিপে হাসল শিলা সুসান। বলল, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি।’
এরপর বাইরের দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘এস আমি গাড়িতে উঠছি।’
শিলা সুসান হাসি মুখে কবিতাংশটি শুরু করেছিল, কিন্তু শেষ করার সময় বেদনায় ভরে যায় তার মুখ। মনের কোণের গোপন একটা বেদনা যেন তার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
‘শুনলে সুসানের কবিতা?’ সান ওয়াকার বলল।
‘আমি ভুরি ভুরি পাইনি, ভুরি ভুরি চাই না। এক তোমাকেই চেয়েছি, পেয়েছি। তাও কেড়ে নেবার আতংক সব সময় আমাকে তাড়া করে ফিরছে। তাই তো ভয় করছে তোমাকে ছেড়ে যেতে। কান্নায় ভারি হয়ে উঠল মেরী রোজ এর কণ্ঠ।
সান ওয়াকার তার একটা হাত মেরী রোজ-এর কাঁধে রেখে সান্ত্বনার স্বরে বেলল, ‘মেঘ কেটে একদিন সুদিনের সোনালী সূর্য উঠবেই।’
শিলা সুসান গাড়িতে উঠার অল্প কিছুক্ষণ পর মেরী রোজ এবং সান ওয়াকারও গাড়িতে এসে উঠল। সান ওয়াকার গাড়ির চালককে নির্দেশ দিল বিমান বন্দরে চল।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
‘কার আছে ভুরি ভুরি সুসান?’ শিলা সুসানকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল মেরী রোজ। সে ভুলতেই পারেনি সুসানের টিপ্পনি।
‘হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে দেখ।’
‘দেখলাম। কিন্তু নেই কার?’
‘পেট ভরা থাকলে কারও ক্ষুধা টের পাওয়া যায় না।’
‘তুই তো কোনদিন বলিসনি ক্ষুধার কথা। সত্যিই এরকম কিছু আছে নাকি?’ হেসে বলল মেরী রোজ।
শিলা সুসানের মুখেও হাসি। ম্লান হাসি। মুহূর্তের মধ্যে সান ওয়াকারের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল মেরী রোজকে, ‘আমি একটা নীতিকথা বলেছি।’
কথাটা শেষ করে একটু থেমেই আবার শুরু করল সে, ‘যাক এসব। আজ এভাবে যাত্রা করতে গিয়ে কিন্তু আহমদ মুসার কথা খুব মনে পড়ছে। বেচারার কি হলো আমরা কোন খোঁজ নিতেও পারলাম না। অথচ আমার উপর একটা দায়িত্ব ছিল তাঁর খোঁজ করা এবং একজনকে জানানো।’
‘শিলা সুসান তুমি ঠিক বলেছ। যে লোক নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাকে বাঁচাল এবং আমাদের নিরাপদ করার জন্য বিপদের সব বোঝা নিজের ঘাড়ে নিয়ে চলে গেল তার জন্যে আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’ বলল সান ওয়াকার।
‘সত্যি আমাদের নামিয়ে দিয়ে যখন উনি যান, তখন তাঁর পেছনে ধাওয়া করছিল তিনটি গাড়ি এবং একটি হেলিকপ্টার। এই অবস্থায় আমাদের বাঁচা অসম্ভব বলেই তিনি আমাদের নামিয়ে দিয়ে আমাদের নিরাপদ করে সব বিপদ নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন। উনি বাঁচতে পেরেছেন কি?’
‘ওভাবে বলিসনে রোজ। অমন প্রশ্ন তোলাও অলুক্ষণে। ওঁকে বাঁচতে হবে। মানুষের জন্যেই বাঁচতে হবে।’ শিলা সুসান বলল।
‘ঈশ্বর তাকে সাহায্য করুন। কিন্তু আমি বলছি একটা অসম্ভব সম্ভব হয়েছি কিনা সেই কথা।’
‘আহমদ মুসাকে আমরা সম্পূর্ণ দেখিনি, তাঁর সবটা আমরা জানি না। কিন্তু গোল্ড ওয়াটারের ফাঁদ তাঁকে আটকাতে পারবে বলে মনে করি না।’ বলল শিলা সুসান।
‘আমিও তাই মনে করি। হোয়াইট ঈগলের বন্দীখানা থেকে বের হবার সময় উনি প্রতিটি দুর্লঙ্ঘ বাধা যে বুদ্ধি ও কৌশলে অতিক্রম করেন, তা না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।’
‘তোমাদে